ঝুমুর নদীর বাঁকে (পর্ব ৪)

 

 

"ঝুমুর নদীর বাঁকে (পর্ব ৪)"
রানুশীল

আগে যা হয়েছে-----

সামন্তরাজ ঈশানদেব রাজ্য হারিয়ে মহাকাল পর্বতের কোলে, ঝুমুর নদীর তীরে রাজ্য গড়লেন, নাম নিলেন বজ্রাদিত্য। এখানে তাঁর এক পুত্র জন্মায়। নাম হয় রুদ্রাদিত্য । তাঁর অপরপুত্র চন্দ্রদেব শত্রুর হাতে পড়ে, এক বণিক উদ্ধার করেন। একথা ঈশানদেব জানেন না। 

এ বংশের জাতকের বাম বাহুতে ত্রিশূল চিহ্ন ও অনামিকায় নীলকান্তমণি থাকে। রাজ্যের নাম হয় "ত্রিনয়নপুরী"। " অরণ্যপতি নাগেশ্বর" নামে অরণ্যবাসীদের দেবতার প্রতিষ্ঠা হয় মহাদেবের আদলে ।


******

রাণী কঙ্কাবতী কথা

*******

ধীরে ধীরে প্রজাসমাগমে পূর্ণ হইল এ রাজ্য। কেহ আসিলেন ভাগ্যান্বেষনে, কেহ বা নিঃস্ব হইয়া, কেহ বা নিগৃহীত হইয়া। ততদিনে বজ্রাদিত্যের দেহান্ত ঘটিয়াছে এবং পুত্র রুদ্রাদিত্য রাজা হইয়াছেন।


রূদ্রাদিত্য কিশোর বয়সেই এক বনিক-কন্যাকে বিবাহ করিয়াছেন ও চারি বৎসরের মধ্যেই মৃগয়ায় গিয়া শার্দুলের হস্তে হাতে প্রাণ হারাইয়াছেন। সেই অবধি গোরাঠাকুর আর ধাত্রী মহামায়ার স্নেহে বাড়িয়া উঠিতে লাগিলেন রুদ্রাদিত্যের পুত্র বুধাদিত্য। তবে রাণী কঙ্কাবতী মাতার কর্তব্য না করিলেও, অধিকার সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। বিশেষতঃ তাঁহার একটি পরিচারিকা জুটিয়াছিল যাহার প্রভাবে রাণীর বিলাসিতা ও নিষ্ঠুরতা সীমা ছাড়াইয়া ছিল।

বুধাদিত্য জঙ্গল ভালোবাসিত.......


*******

একটি খরগোশ ঝোপের তলায় বসিয়া থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল। একটি বালককে দেখা গেল চুপিসারে তাহার দিকে অগ্রসর হইতেছে। তাহার হস্তে তিরধনুক কিন্তু সে বনচারী নয়, পরনে রাজপোশাক। তাহার চোখের স্থির দৃষ্টি ঝোপের দিকে । খরগোশটির সামান্য আভাসই তাহার পক্ষে যথেষ্ট। সে ধনুকে বাণ সংযোজন করিল-----ইতিমধ্যে একটি আভীরকন্যা কোথা হইতে আসিয়া খরগোশটিকে ক্রোড়ে তুলিয়া লইল। কিন্তু তির ততক্ষণে ধনুকের ছিলা ত্যাগ করিয়া

---সাঁৎ--- শব্দে বাতাস কাটিয়া আসিয়া বিঁধিয়া গেল কন্যার পায়ে। 


কন্যার আর্তনাদ শুনিয়া বালকটি দ্রুত পদে আসিয়া দেখিল তাহার পায়ে তির বিঁধিয়া আছে। সে তৎক্ষণাৎ তিরটি বাহির করিয়া একটি বিশেষ পত্রের সন্ধানে চারিদিকে দেখিতে লাগিল। না পাইয়া বলিল ,

----------কোন পাতায় যেন রক্ত বন্ধ হয় ? এই ! তুমি জান ?

কাঁদিতে কাঁদিতে আভীর কন্যা বলিল , 

-----------'এই' বলবে না। আমি রোহিনী ! ঐ তো পাতা, তুমি তো রাজা হবে , তাই জান না। 


রাজপুত্র পত্র দিয়া বাঁধিয়া দিল ক্ষত। রোহিনীকে দুই হস্তে তুলিয়া , রাজবাটি অভিমুখে চলিতে লাগিল। নিকটে পৌঁছনোর পূর্বেই গোরা ঠাকুর আসিয়া বলিলেন, 

--------একি করছো বুধাদিত্য !! রেখে দাও ওকে রেখে দাও। রাণীমা দেখলে !!!


তাহার পর হইতে প্রায় প্রত্যহই সাক্ষাৎ হইত বুধাদিত্য আর রোহিনীর। তাহারা বনের মধ্যে ছুটোছুটি করিয়া খেলিত, বুনো ফল খাইত, ঝুমুরের জলে সাঁতার কাটিত। গোরা ঠাকুরের নীরব প্রশ্রয়ে তাহারা ও তাহাদের কিশোর প্রেম ধীরেসুস্থে বাড়িয়া উঠিতে লাগিল।


*****

সন্ধ্যা হইয়া আসিতছে। রোহিনী ঝুমুরের তীরে শুভ্র চরের উপরে শুইয়াছিল। আর বুধাদিত্য রোহিনীর কুন্তল রাশি লইয়া খেলা করিতেছিল। রোহিনী আকাশে আঙুল দেখাইয়া বলিল,

------ও ও ও ই ই খানে রোহিনী নক্ষত্র আছে। আমার জন্য মন খারাপ করলে রোহিনীকে দেখো-------

-------কেন ? মন খারাপ করবে কেন? তুমি তো আমার রাণী হবে -----

-------না না অমন কথা বোলোনা রাজকুমার, আমি তোমার মালিনী হব। রোজ তোমায় ফুল দিয়ে আসবো। তুমি রাজকার্য করবে,আর আমি দূর থেকে দেখবো আমার রাজাকে । তোমার জন্য তো রাজকন্যে আসবে। 

-------এসেছে তো ! আভীর গোষ্ঠীপতি হিরণ্যর পুত্রী তুমি। তোমার মর্যাদাই বা কম কিসে ? গোরা ঠাকুরের ছাত্র বাণীকন্ঠ তোমাকে শিক্ষিত করে তুলছেন , সেতো আমারই জন্য । 


রোহিনীর পঞ্চদশী মন আপ্লুত হইয়া পড়িল, তাহার বক্ষ দুরু দুরু করিতে থাকিল, -----সে মনে মনে প্রার্থনা করিল,

------মা ঝুমুর ! দেখো যেন আমার রাজার এ ইচ্ছে সফল হয় ! আমি যেন তার যোগ্য হয়ে উঠতে পারি------


রোহিনীর এ ব্যাকুলতা বুঝিল না বুধাদিত্য, সে পুরুষ । তাহার উপর রাজপুত্র। রোহিনী তাহার পায়ে সমর্পিতা হইবে ইহাই স্বাভাবিক। তাহার ষোড়শ হৃদয় রোহিনীর আবেগ-স্ফুরিত অধরের পানে চাহিয়া মনের মধ্যে স্বর্গ রচনা করিতে লাগিল। 


ঝুমুরের জল ও স্ফীত হইয়া যেন রোহিনীর হৃদয়ের প্রতিধ্বনি করিতে লাগিল। বোধকরি জোয়ার আসিল। সুউচ্চ ঊর্মিমালা পাড়ে ভাঙিয়া পড়িতেছে, জল রোহিনী ও বুধাদিত্যের চরণ স্পর্শ করিল।


বুধাদিত্যের অধর ক্রমশ কাছে আসিয়া রোহিনীর কপোল স্পর্শ করিল, রোহিনীর সমস্ত চেতনা গলিয়া গলিয়া বুধাদিত্যের উষ্ণতায় দ্রবীভূত হইতে লাগিল। সে বংশপত্রের ন্যায় তিরতির্ করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। বুধাদিত্যের বলিষ্ঠ অধর তাহার কোমল রক্তিম অধরের সবটুকু কোমলতা যেন শুষিয়া লইতে লাগিল...দুইটি কিশোর হৃদয় এক হইয়া গেল, যেন একটি পদ্ম কোরক সূর্যালোকে প্রস্ফুটিত হইয়া উঠিল....


তাহারা জানিল না, একজন ধীবর কিশোর অলক্ষ্যে থাকিয়া তাহাদের লক্ষ্য করিতেছে, ও ঈর্ষায় নীলবর্ণ হইতেছে।


এমত সময়ে

অতি কর্কশ একটি কণ্ঠ তাহাদের স্বপ্নের জগৎ হইতে কঠিন পৃথ্বিতলে আছড়াইয়া ফেলিল। 

--------কুমার ! তুমি এখানে ! ----

রাণীমার প্রধানা পরিচারিকা বাসন্তী , তাহাদের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। 


রোহিনী ও বুধাদিত্য সহসা বিচ্ছিন্ন হইল। যেন বৃন্ত হইতে কোনো কুসুম ছিন্ন করা হইল। সবার অলক্ষ্যে তাহাদের হৃদয় তন্তুর সুর কাটিয়া গেল। 


বাসন্তীর যেমন চেহারা, তেমনই স্বভাব। তার ত্রিসীমানায় নম্রতা শব্দটি নাই । সে এই জঙ্গলেরই মানুষ। সাগর-পাটনী তাহার পিতা। তবে তাহার মাতা ছিল অন্যদেশের মেয়ে, ঝুমুরের জলে ভাসিয়া আসিয়াছিল তাহার মাতা। কোথা হইতে আসিয়াছিল , কেনইবা ঝুমুরের জলে ভাসিয়া চলিয়াছিল, তাহা বহুবার জানিতে চাহিয়াও বিফল হইয়াছিল সাগর।বাসন্তীর মাতাকে উদ্ধার করিয়া সে স্ত্রীর সম্মান দিয়াছিল। 


জনশ্রুতি রহিয়াছে, বাসন্তী সাগরের কন্যা নহে, তাহার মাতা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ভাসিয়া আসিয়াছিল। বাসন্তী বোধকরি নিজেও বিশ্বাস করিত না, যে, সে পাটনী-কন্যা। বালিকা বয়স হইতেই সে রাজবাড়ির নানা কাজ করিত। বর্তমানে সে রুদ্রাদিত্যের রাণী কঙ্কাবতীর প্রধানা পরিচারিকা, সম্পর্কটা তাহাদের প্রায় সখ্যতার।


সে রাজপুত্রের এহেন পদস্খলন, রাণীমার গোচরে আনিবে এ আর বেশি কথা কি ? তাহারই ফল স্বরূপ রাণীমার কক্ষে রাজপুত্রের ডাক পড়িল। বুধাদিত্যের সহিত অত্যন্ত অহংকারী মাতার সাক্ষাৎ বড় একটা হয়না। সে মাতার সম্মুখে নত মস্তকে দাঁড়াইয়াছিল। ইহাই সৌজন্য। কিন্তু তাহার মন বিদ্রোহ করিতেছিল। সে মনে মনে স্থির করিয়াছিল,------মাতা যাহাই বলুন, রোহিনীকে সে ত্যাগ করিবেনা। 


রাণী কঙ্কাবতী স্বামী হারাইলেও বিলাসিতা বর্জন করেন নাই, বিশেষত বাসন্তীর সঙ্গদোষে ইহা উত্তরোত্তর বিকৃত পথে যাইতেছিল। তাঁহার চোখে মুখে ভোগলিপ্সু এক নারীর অতৃপ্তি ফুটিয়া বাহির হয়। পুত্রের নিকট তাহা কর্কশ রূপে প্রতীয়মান হইল। তিনি তিক্তকণ্ঠে বলিলেন , 

--------বনে জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করার স্বভাবটা তোমার পিতার দান, কিন্তু মনে রেখো, রাজকোষে

যে অর্থ ঐসব ইতর শ্রেণীর মানুষ জমা দেয় , তাতে রাজপরিবারের প্রয়োজন মেটেনা। একটি রাজকন্যার সাথে তোমার বিবাহ স্থির করা হচ্ছে। তুমি ওই ----কি যেন নাম গোয়ালিনীটার ? হ্যাঁ , রোহিনী -----তার সাথে আর কখনও দেখা করবেনা। এটা আমার আদেশ, অন্যথা হলে ফল ভালো হবে না।

বাসন্তীর সহিত দৃষ্টি বিনিময় হইতেই কি যেন ইঙ্গিত হইয়া গেল, পুত্রকে বলিলেন, 

-------এখন যাও -------

******

গোরা ঠাকুর দ্রুতপদে রাণী কঙ্কাবতীর মহলে যাইতেছিলেন। ডাক আসিয়াছে। তিনি বিরক্ত। বুধাদিত্য ও রোহিনীর জন্য খানিকটা শঙ্কিতও। গোরাঠাকুর মনে মনে জানেন রাণী কি জন্য ডাকিয়াছেন। রাণীর মহলের বাহিরের দর্শনার্থীর কক্ষে আসিলেন। বাসন্তী বলিল, 

---------বসুন ঠাকুর ---রাণীমা আসছেন----

সম্মুখে একটি চিকের আড়াল। অপর পার্শ্বে অলংকার বাজিল , রাণী আসিলেন-----তাঁহার কণ্ঠস্বর শুনা যাইল,

-------সব কুশল তো ঠাকুর ?

-------হ্যাঁ রাণীমা

-------আপনি তো মিথ্যা বলতেন না ঠাকুর !

------এখনও বলিনা -----

-------বলেছেন , রাজ্যের বিপদ আসন্ন-----

-------আমার তো কিছু জানা নেই !

-------জানেন। আপনি জানেন। কুমার একটি আভীর কন্যাকে নিয়ে খেলায় মেতেছে। আপনি জেনেশুনে তাদের প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন------


গোরা ঠাকুরের মুখ গম্ভীর হইয়া উঠিল। বলিলেন,

------- ওর পিতা হিরণ্যই রাজপুরীতে দুগ্ধের প্রয়োজন মেটায়, স্বয়ং বজ্রদেব তাকে পাঁচশত গাভী দান করেছিলেন, এখন তা সহস্র ছাড়িয়ে গেছে ------ গোসম্পদ তারও কিছু কম নয়। কন্যাটি অত্যন্ত বুদ্ধিমতি, সুশীলা ও ধর্মজ্ঞান সম্পন্না , তাই সে কোনোভাবেই খেলার যোগ্য নয়, কুমার তাকে প্রীতির চোখে দেখেন ------


--------ও ও---তবে সেই এরাজ্যের ভবিষ্যতের রাজ্ঞী ? কিন্তু আমার তাকে পছন্দ নয়-----


-------ক্ষমা করবেন রাণী মা , আমি পছন্দের ব্যাপারে কুমারকেই প্রাধান্য দেব------

-------বেশ , এখন আসুন --------


গোরাঠাকুর চলিয়া আসিলেন বটে, মনের মধ্যে শঙ্কা কাটিল না। ঐ বাসন্তী রাণীকে চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে দিবে না। তাহারা কি করিতে পারে !! তিনি মনে মনে ভাবিতে ভাবিতে চলিলেন।

******


রাণী মার মুখের পানে চাহিয়া বাসন্তী ভাবিল, 

------যদি ঐ রোহিনী রাণী হয় তাহা হইলে তাহার গুরুত্ব রাণী কঙ্কাবতীর সাথে সাথে কমিয়া যাইবে। রাজমাতা হইতে রাণীর গুরুত্ব বেশি। অতএব এমন রাণী আনিতে হইবে যাহার বুদ্ধি অল্প, যে তাহার বশে থাকিবে। 

বাসন্তী রাণী কঙ্কাবতীর পদতলে গুছাইয়া বসিল। কূটবুদ্ধির জালে তাহাকে "কার্য " সিদ্ধ করিতে হইবে।


কোন মন্তব্য নেই

luoman থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.