ঝুমুর নদীর বাঁকে (পর্ব ৩)


"ঝুমুর নদীর বাঁকে (পর্ব ৩)"
রানুশীল



অগে যা হয়েছে-------
বাংলায় গুপ্তযুগের শেষে সামন্তরাজ ঈশানদেব রাজ্য হারিয়ে মহাকাল পর্বতের কোলের বনাঞ্চলে আশ্রয় নেন।সেখানে পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়ে রাণী মারা যান।
এদিকে আহত অবস্থায় রাজার অনার্য রাণীও তাঁর পুত্র চন্দ্রদেবকে এক বণিক উদ্ধার করে মহানদীর অপর পাড়ে নিয়ে যায়।
এক যোগী অরণ্যবাসীদের ওপর অত্যাচার করে। রাজা এখানকার মানুষদের নিয়ে রাজ্য গড়ার কথা ভাবেন। এমন সময় পাহাড়ে আগুন লাগে.......তারপর........

******
অরণ্যপতি নাগেশ্বর 
******
মানুষ প্রাণ ভয়ে ঘরের মধ্যে লুকাইয়া পড়িল। ও উচ্চৈঃস্বরে 
----বুড়োবাবা রক্ষা করো----
বলিয়া চিৎকার জুড়িয়া দিল। 
ঈশানদেব তাঁহার অনুচরদের লইয়া পর্বতে আরোহন করিলেন। পশুরা এখন প্রাণ বাঁচাইতে ব্যস্ত, আক্রমন করিল না। তাঁহারা দেখিলেন, অগ্নি তত বিশাল নহে। পার্শ্ববর্তী কিছু বৃক্ষ ছেদন করিলেই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। তাহারা প্রাণপনে বৃক্ষ ছেদন করিতে লাগিল। স্থানীয় মানুষও হৈ হৈ করিয়া আসিল। কেহ গাছ কাটিল , কেহ জল আনিয়া মাটি ভিজাইল। 

ধীরে ধীরে অগ্নির তীব্রতা কমিয়া আসিল। পশুর কোলাহলও কমিয়া আসিল। লোকে হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল , ঈশান দেবের নামে জয়ধ্বনি দিয়া তাহারা দলে দলে "বুড়োবাবার থানে" চলিল। ঈশানদেবও তাহাদের সাথে চলিলেন। দেখিলেন, একটি সুবৃহৎ বৃক্ষকাণ্ডে অদ্ভুতাকৃতি মনুষ্যমূর্তি খোদাই করিয়া ইহারা অর্চনা করে। উহাই ইহাদের দেবতা "বুড়োবাবা"। 

ঈশানদেব লক্ষ্য করিলেন, বুড়োবাবার সহিত মহাদেবের মূর্তির সাদৃশ্য রহিয়াছে। মূর্তির হস্তে ত্রিকোন ফলা বিশিষ্ট একটি বৃক্ষশাখা রহিয়াছে। তাহার তিনটি ফলায় তিনটি চক্ষুর চিহ্ন খোদিত, ঐ চক্ষুই নাকি অরণ্যের উপর দৃষ্টি রাখে। তিনি ভাবিলেন, ইহাদের বুড়োবাবাকে উপযুক্ত সম্মান দিতে হইবে-----
****
রাজা তাঁহার এক অনুচরকে পাঠাইলেন ,রাজ বৈদ্যকে ও জ্যোতিষাচার্যকে আনিবার জন্য। তাঁহারা এক সুরক্ষিত স্থানে রহিয়াছেন ! আসিবার সময় এমনই শুনিয়া আসিয়াছেন। রাণী পুষ্পা ও চন্দ্রদেবকে লইয়া মহেন্দ্র কোথায় যাইলেন তাহারও যেন অনুসন্ধান করে, তবে সাবধানে, শত্রুরা যেন জানিতে না পারে। রাজপুত্রের জন্মের সপ্তম দিনে নামকরণ হয়। আর রাজকীয় চিহ্নও অঙ্কিত করা হয়। যদি রাজবৈদ্যকে পাওয়া যায় ভালো। অন্যথায় তাঁহাকে নিজেকেই করিতে হইবে এই কার্য। 

গতকল্যের অসুস্থ বালকটিকে দেখিতে যাইলেন ঈশান দেব। খুব বেশি পরিবর্তন হয় নাই অবস্থার।ওর মাতা পা দুইটা জড়াইয়া ধরিল, 
-----------তুমি নিশ্চয়ই রাজা, তুমি পারবে !! একটা কিছু করো, ঐ যোগী আমাদের ছেলেদের বাঁচতে দেবেনা , এখানকার সাতজন ছেলে চলে গেল, আমার ছেলেটাকে বাঁচাও----

ঈশানদেব বুঝিলেন, এরা সৌজন্য এখনও শিখিয়া উঠিতে পারে নাই। কোনো যুক্তি বুদ্ধি দিয়া ইহাদের বোঝানো যাইবে না। আবেগকে কাজে লাগাইতে হইবে। ঈশানদেব বলিলেন, 
----তোমাদের বুড়োবাবাকে মনের কথা জানাও। যোগীকে বিশ্বাস কর না------

*****
সহচরটি তৃতীয় দিনে রাজবৈদ্য ও জ্যোতিষাচার্যকে লইয়া ফিরিল। বৈদ্যরাজ অসুস্থ বালকটিকে পরীক্ষা করিয়া ঔষুধ দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃতপ্রায় অজ্ঞান বালক চক্ষু মেলিল। ঈশানদেব ও রাজবৈদ্যের জয়জয়কার উঠিল। অশিক্ষিত অসহায় মানুষগুলি আশার আলো দেখিল। 

বুড়োবাবার মন্দিরের স্থাপনা করিয়া, তাঁহার মূর্তি গড়া হইল, মহাদেবের আদলে । হস্তে একটি ত্রিশূল দেওয়া হইল, যা ঈশানদেবের বংশের প্রতীকচিহ্ন। নামকরণ হইল,"অরণ্যপতি নাগেশ্বর"।স্থানীয় মানুষকে অর্থ বুঝানো হইল , তাহাদের খুব পছন্দ হইল নামটি। একটি নাগকেশরের বৃক্ষ ও অপরাজিতা পুষ্পের লতা মন্দির প্রাঙ্গণে জন্মাইল। যেন দেবতার পায়ে অর্পিত হইবার জন্যই----

জ্যোতিষাচার্য রাজপুত্রের নাম দিলেন---- রুদ্রাদিত্য----- রাজা অবাক হইলেন ,
-----জ্যোতিষাচার্য ! আমরা "দেব" উপাধি ধারন করি----
জ্যোতিষাচার্য ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন , 
------যথার্থ ! কিন্তু মহারাজ আপনার শত্রুগনের হাত থেকে রাজ্যকে নিরাপদ রাখতে গেলে নাম পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। আমি আপনারও নুতন নামকরণ করলাম, 
"বজ্রাদিত্য"---পত্তন হোক নুতন রাজ্য "ত্রিনয়নপুরী"।
এ প্রস্তাব সকলে বেশ খুশী মনেই গ্রহন করিল।

বৈদ্যরাজ সপ্তম দিবসে রাজপুত্রের বাম বাহুতে তরবারি দিয়া একটি ত্রিশূল চিহ্ন আঁকিয়া দিলেন। এবং তৎক্ষণাৎ একটি বিশেষ পত্রের প্রলেপ লাগাইয়া দিলেন, ক্ষত শুকাইয়া শুধু চিহ্নটুকুই থাকিবে , সারাজীবন । জ্যোতিষাচার্য একটি নীলকান্তমণির অঙ্গুরীয় ধারন করাইলেন রাজপুত্রের অনামিকায়। ইহাই এ বংশের পরিচয়। আবার এই অঙ্গুরীয় অষ্টাদশ বৎসরে ধারন করা হইবে , অভিষেকের সময়।

এর পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। যোগী মহাশয় বিতারিত হইল। তাহার সহকারিটি রাজা বজ্রাদিত্যের প্রধান পরিচারক হইল, তাহার আর গৃহে যাওয়া হয় নাই , ততদিনে তাহার পিতামাতা জীবিত ছিলেন না। 

আরোও একটি কথা বৈদ্যরাজ জানাইলেন,
------রাণী পুষ্পা ও তার পুত্রসন্তান চন্দ্রদেব, সচীব মহেন্দ্রের সহিত আসিতেছিলেন। কিন্তু পথেই নিহত হইয়াছেন----এমনই সংবাদ তিনি পাইয়াছেন। সত্য মিথ্যা সবিশেষ বলিতে পারেন না । তিনি নিজেও অশেষ ক্লেশ ভোগ করিয়াছেন------

এদিকে বজ্রাদিত্যের নতুন রাজ্যের কথা শুনিয়া, পুরোনো অনুগত প্রজারা অনেকেই চলিয়া আসিয়াছিল। তাহাদের মুখেই গৌড় ও হর্ষবর্ধন আর শশাঙ্কদেবের খবর পাইলেন রাজা। নর্মদার দক্ষিণে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তখন বাতাপির চালুক্য বংশের রাজত্ব। চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশী, হর্ষবর্ধন, শশাঙ্ক তখন কনৌজের দখল লইয়া যুদ্ধে ব্যস্ত হইয়া আছেন। এরাজ্যের প্রতি মনোযোগ দিবার সময় ও ইচ্ছা তাহাদের ছিলনা। 

অতএব নিশ্চিন্তে এ রাজ্যটি প্রকৃতির ক্রোড়ে শিশুর মতই পরিনত হইয়া উঠিল। বজ্রাদিত্যেরও কোনো আগ্রহ ছিলনা বহির্বিশ্বের প্রতি। 

অরণ্যপতির মন্দিরে পুজার জন্য পিতার সহিত এ রাজ্যে আসিয়াছিলেন গোরাঠাকুর। তিনি তখন কিশোর। তিনি বৈদিক মন্ত্রের সহিত সঙ্গীত জুড়িয়া এক নূতন পূজা পদ্ধতি সৃষ্টি করিলেন। তাঁহার মন্ত্রের সহিত বনাঞ্চলের মানুষও আড়ষ্ট জিহ্বায় মন্ত্র উচ্চারণ করিল । সে মন্ত্রে ব্যাকরণ না থাক, আবেগ ছিল, শুদ্ধতা না থাক মাদকতা ছিল। পবিত্রতায় আপ্লুত হইয়া উঠিত নূতন রাজ্য "ত্রিনয়নপুরী"। 

রাজা বজ্রাদিত্য আর দার পরিগ্রহ করেন নাই। তিনি এ অঞ্চলের উন্নতিকল্পে প্রাণ ঢালিয়া দিলেন। এক আভীর গোষ্ঠীপতি তাঁহাকে এ কার্যে সাহায্য করিল। সে হীরণ্য। বজ্রাদিত্য হীরণ্যকে পুত্রবৎ স্নেহ করিতেন। 

অন্তর্যামী বোধকরি অলক্ষ্যে হাসিয়াছিলেন, তাঁহারই অঙ্গুলিসঙ্কেতে, ইহাদের প্রীতি ঝুমুর নদীর ঘূর্ণিপাকের মতো বৃত্তাকার পথে চালিত হইল........

(ক্রমশঃ)

কোন মন্তব্য নেই

luoman থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.