"ঝুমুর নদীর বাঁকে (পর্ব ২)"
"ঝুমুর নদীর বাঁকে (পর্ব ২)"
✒ রাণুশীল
বাংলায় গুপ্তযুগের শেষ। ঈশানদেব নামে এক সামন্ত রাজা তার রাজ্য হারিয়ে আসন্নপ্রসবা রাণীকে নিয়ে মহাকাল পর্বতের বনাঞ্চলে আসেন। তাঁর এক অনার্য রাণী ও শিশুপুত্র চন্দ্রদেব সচীব মহেন্দ্রর সাথে শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে বনের মধ্যে দিয়ে পালাতে গিয়ে জ্ঞান হারালেন। এক বণিক তাদের উদ্ধার করে, মহানদীর অন্যপাড়ে নিয়ে যান। একরাত্রে ঈশানদেব বনমধ্যে মন্ত্র আর কান্না শুনে জেগে ওঠেন। অনুসন্ধান করতে গিয়া আগুন ও কিছু মানুষ দেখেয খুব অবাক হলেন । তারপর.....
****
আরও সাবধানী হইতে হইল তাহাদের। ওইখান হইতেই আসিতেছে চাপা অথচ বুকফাটা ক্রন্দনধ্বনি। এবার আরোও সন্তর্পনে চলিলেন। প্রতিমুহূর্তে আশঙ্কা হইতেছিল ভীষণ একটা কিছুর জন্য। আরোও একটু নিকটে আসিয়া দেখিলেন---
অগ্নির সম্মুখে বসিয়া আছে জটাজুটধারী প্রায় নগ্ন ভীষণদর্শন এক মানুষ, তাহার ললাটে রক্তবর্ণ সিন্দুরের লেপন, কণ্ঠে রুদ্রাক্ষের মালা। চোখদুটি জ্বলিতেছে, আরোও দুইটি অগ্নিশিখা যেন। সে অদ্ভুত মন্ত্র উচ্চারণ করিতেছে ও মধ্যে মধ্যে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিতেছে,অগ্নি চড়চড়্ শব্দে দ্বিগুণ হইয়া উঠিতেছে।
ঈশানদেবের ললাটে আর চক্ষুতেও সেই অগ্নির রক্তাভা। ঐ ভীষণদর্শন মানুষটির একেবারে সম্মুখে আসিয়া দেখিলেন, ওদের দিকে পৃষ্ট করিয়া বসিয়া আছে একটি স্ত্রীলোক, তাহার ক্রোড়ে শির রাখিয়া শুইয়া রহিয়াছে কেহ। আশেপাশে হাত জোড় করিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে জনাসাতেক মানুষ। ব্যাপারটা কি হইতেছে দেখিবার জন্য ঈশানদেব চলিলেন অপরদিকে, সন্তর্পনে। এবার স্পষ্ট দেখা যাইল শায়িত রহিয়াছে একটি বছর সাতেকের শিশু, তাহার সর্বাঙ্গে সিঁদুরের প্রলেপ, যে স্ত্রীলোকটি কাঁদিতেছে, সে সম্ভবত শিশুটির মাতা। সমস্ত পরিবেশ ভয়াবহ রক্তিম বর্ণ ধারণ করিয়াছে।
*****
রাজরক্ত
*****
একটা খসখস্ শব্দে ঈশানদেব চমকিয়া তাকাইলেন, কোনো পশু ? না কি কেহ আসিতেছে ? সম্ভবত কেহ আসিতেছে, সতর্ক হইলেন তাঁহারা।
ক্ষণিক মধ্যেই দেখিলেন জটাধারী এক সাধুকে, তাহার চেহারা খর্ব ও শীর্ণ। ঈশানদেব সহচরকে ইঙ্গিত করিলেন। সে বুঝিল তাহাকে কি করিতে হইবে , সামান্য পশ্চাতে গিয়া প্রায় নিঃশব্দে একটি শাল্মলী বৃক্ষের অন্তরালে দাঁড়াইল।
সাধুটি নিশ্চিন্ত মনে একটি কাষ্ঠ দন্ড অথবা বৃক্ষশাখা হস্তে লইয়া তাহাদের সম্মুখের পথ ধরিয়া আসিতেছে। সে ঈশানদেবকে পার হইয়া গেল। সহচরটি রহিয়াছে একটু দূরে। হঠাৎ সে আড়াল হইতে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল । সম্মুখে এরকম অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া
সাধুটি দাঁড়াইয়া পড়িতেই, ঈশানদেব ঝাঁপাইয়া পড়িলেন তাহার উপর। সাধু মাটিতে পড়িতেই সহচর তাহার মুখটি উত্তরীয় দিয়া দৃঢ়ভাবে বাঁধিয়া ফেলিল। আর সামান্য শব্দও সে করিতে পারিলনা। উহাকে বহিয়া লইয়া চলিল কুটিরে , ঘিরিয়া বসিল সবাই। ঈশান দেব বলিলেন,
-----কি ব্যাপার ! কি হচ্ছে এখানে ? মনে হচ্ছে তোমরা স্থানীয় মানুষ নও ? সব সত্যি কথা বলো, নাহলে....তাহারা ঝকঝকে তরবারি দেখাইল,
----আমরা রাজার সৈনিক।
লোকটির মুখ শুকাইয়া গেল, ইঙ্গিতে বন্ধন খুলিয়া দিতে বলিল, জল পানের ভঙ্গি করিল।
ঈশানদেব তাহাকে বাঁধন খুলিয়া জল দিলেন, কিন্তু তরবারি বক্ষে স্পর্শ করিয়া রহিলেন। জল পান করিয়া একটু সুস্থ হইল।বলিল,
------আমি দক্ষিণের এক ব্যবসায়ীর পুত্র। ওখানে এক ধরনের যোগীরা হঠযোগের দ্বারা রোগ নিরাময় করে। সেইভাবেই আমাকেও সারিয়ে তুলেছিল ঐ যোগী। শর্ত ছিল , সেরে গেলে পরিবারের একজনকে যোগী হতে হবে। পরিবারে বৃদ্ধ বাবা মা। তাই আমাকেই আসতে হয়েছে। এরা অনেক অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী। হঠযোগীদের অত্যন্ত কঠিন নিয়ম পালন করতে হয়।
সমস্ত শুনিয়া ঈশানদেবের মুখ গম্ভীর হইয়া গেল। তিনি জানিতে চাহিলেন,
------এখানে বালকটিকে নিয়ে কি করা হবে ?
------ওর উদরপীড়া ও বমন হচ্ছে, শর্ত সেই একই , যোগী হতে হবে। ওর জননীর তাই বুকভাঙা কান্না।
ঈশানদেব হস্তদুটি বদ্ধ করিয়া ঋজু ভঙ্গিতে পদচারনা করিতে লাগিলেন। তাঁহার মস্তিষ্কে তখন রাজবুদ্ধি জাল রচনা করিতেছে। তিনি ভাবিতেছিলেন, এই বিপুল বনাঞ্চল, এখানকার অশিক্ষিত মানুষ, যাহারা প্রকৃতি আর কুসংস্কারের নিকট অসহায়, ইহাদের এই অবস্থা হইতে মুক্ত করিতে পারিলে, এই স্থান রাজ্য স্থাপনের পক্ষে উপযুক্ত।
তাঁহার অভিজ্ঞ মস্তিষ্কে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো একটি ভাবনা দ্রুত শাখাপ্রশাখা বিস্তার করিল। ----তিনি রাজবৈদ্যকে আর জ্যোতিষাচার্য্যকে ডাকিয়া আনিবেন। ইহাদের সহিত আরোও গভীর ভাবে মিশিতে হইবে, জানিতে হইবে, যোগীর সম্পর্কে ইহারা কি ভাবিতেছে....
তিনি চারিদিকে তাকাইয়া দেখিলেন, উত্তর-পশ্চিমে পাহাড়, পূর্ব-দক্ষিণে নদী , এ অঞ্চল ভৌগোলিক দিক দিয়া সুরক্ষিত । পাহাড়ি অঞ্চলে হস্তী রহিয়াছে অনেক। তাহাদের কাজে লাগানো যাইবে। হরিণ, খরগোশ কিছুরই অভাব নাই। ঝুমুর নদীতে প্রচুর মাছ।
সর্বাগ্রে প্রয়োজন এদের ঐ যোগীর কবল হইতে রক্ষা করা। ঈশানদেব ঐ লোকটির সম্মুখে একটি বড় প্রস্তরখন্ডে বসিলেন, ধীরকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন,
-----তুমি কি এ জীবন থেকে মুক্তি চাও?
-----না না ঐ যোগীর অনেক শক্তি, আমায় মেরে ফেলবে।
----ভয় পেওনা !! তোমার মনবাঞ্ছা বল।
----আমি বাড়ি যাব।
----বেশ ! তবে আমাকে সাহায্য করো..
-----কি সাহায্য ?
----ঐ যোগী, বালকটিকে এখানেই রাখবে ?
-----না, দক্ষিণ দিকে আরোও গভীর বন।সেখানে আরোও যোগী আছে। নিয়ম ভাঙলে উপবাস আর কঠিন পরিশ্রম। সবাই বাঁচেনা। বালককে সেখানেই পাঠাবে।
-----আশ্চর্য !! ওদের উদ্দেশ্য কি ?
-----ক্ষমতা লাভ আর বিশ্বস্ত অনুচর তৈরি, ওরা সারা দেশে ওদের আধিপত্য চায়....
ঈশানদেবের ছেলেটিকে ভালো লাগিল। বেশ বুদ্ধিমান। বলিলেন,
----ঐ বালককে তুমি নিয়ে যাবে?
----হ্যাঁ, আমাকে অন্য একজনের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
----বেশ !! তোমায় বিশ্বাস করতে পারি ?
----আপনি কী রাজা ??
-----খুব বুদ্ধি তোমার ! এখন তুমি যাও। বলবে পথ ভুল করেছিলে তাই দেরি হলো ।
*****
ছেলেটি কি বিশ্বাসঘাতকতা করিবে ? ঈশানদেবের অভিজ্ঞ চোখ বলিতেছে,
----করিবে না।
একজন সংবাদ দিল, ---রাণী ডাকিতেছেন--
ঈশানদেব দ্রুতপদে রাণীর নিকট গিয়া দেখিলেন , ম্লান আলোকে তৃণের শয্যায় তিনি ছটফট্ করিতেছেন আসন্ন মাতৃত্বের যন্ত্রণায়। রাজাকে দেখিয়া সকলে বাহিরে যাইল।
রাণী কাতর কণ্ঠে বলিলেন,
----আমি বাঁচব না। তুমি রাজত্ব স্থাপন করো, আমার পুত্র যেন রাজা হয়---
রাজা রাণীর মস্তক স্পর্শ করিয়া অঙ্গীকার করিলেন। চিন্তাকুল আননে বাহিরে আসিলেন।
রাণীর যন্ত্রণাকাতর শব্দগুলি তাঁহার মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাক খাইতে লাগিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রাণীর যন্ত্রণার কাতরতা ছাড়াইয়া একটি শিশুকণ্ঠ জাগিয়া উঠিল। রাজা অস্থিরভাবে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে একটি শিশুপুত্রকে পাতায় মুড়িয়া আনিল এক স্ত্রীলোক। রাজা তাহার মস্তক চুম্বন করিলেন। সপ্রশ্ন চোখ তুলিয়া বলিলেন,
-----রাণী ?
স্ত্রীলোকটি মাথা দুইদিকে নাড়াইয়া বুঝাইয়া দিল তিনি আর ইহলোকে নাই।
রাজা স্তম্ভিত হইয়া কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া শিশুটিকে ঐ স্ত্রীলোকের হস্তে তুলিয়া দিলেন।
-----আজ থেকে একে মানুষ করো তুমি---
আমি এখানেই থাকব। এ আমার পুত্রের জন্মভূমি ।
রাজার শোক মানায় না। ঊষাকাল উপস্থিত। তাঁহার এখন অনেক কার্য। রাণীকে ঝুমুরের বালুকাময় তীরে দাহ করা হইল। রাজকীয় সম্মান তাঁহার জুটিল না। এমত সময়ে দূর অরণ্য হইতে কয়েকটি হস্তী ডাকিয়া উঠিল। রাজার আনন হাসিতে ভরিয়া উঠিল। মনে মনে বলিলেন,
-----এ অরণ্য-পর্বত তোমায় বিদায় জানালো রাণী!এখানেই রাজত্ব স্থাপন হবে । তোমার পুত্র রাজা হবে।
অকস্মাৎ ব্যাঘ্র গর্জনে অরণ্য কাঁপিয়া উঠিল। বিকট শব্দে চারাদিক মুখর হইয়া উঠিল। অনেক পশুর পদধ্বনিতে বোধ হইল পাহাড় ধসিয়া পড়িবে!!
একপাল হরিণ তীব্র বেগে ছুটিয়া ঝুমুরের দিকে আসিল.....
স্থানীয় মানুষও উদ্বিগ্ন।বলিল,
-----জঙ্গলে আগুন লেগেছে-----সবাই ঘরে ঢুকে পড়ো----জানোয়ারদের পথ দাও------
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই