ঝুমুর নদীর বাঁকে (পর্ব ১)


 

"ঝুমুর নদীর বাঁকে (পর্ব ১)"

✒ রাণুশীল


পর্ব~~১

ইতিহাসে আমরা প্রকৃত ঘটনার যৎকিঞ্চিৎ অবগত হই, কিন্তু তাহার পরতে পরতে সঞ্চিত থাকে ততোধিক অব্যক্ত কাহিনী। 

বহু মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর যন্ত্রণা ও বহু জীবনের বলিদানে লুপ্ত হয় এক একটি রাজবংশ, নীরবে। কখনও বা পাপের ভারে.....কখনও বা....কালের নিয়মে......
মহাকাল পর্বতের পাদদেশের ত্রিনয়নপুরী রাজ্যের ধ্বংসাবশেষে আজও প্রতিধ্বনিত হয় দীর্ঘশ্বাস ও আর্তনাদ.....

*****
চন্দ্রদেবকথা 
*****

বাংলায় গুপ্তসাম্রাজ্য তখন পতোনোন্মুখ। হুণ আক্রমণে পাটলিপুত্রের ঔজ্জ্বল্য ম্লান হইতে না হইতেই সামন্ত রাজারা শক্তি সঞ্চয়ে ব্যগ্র হইয়া পড়িলেন। সর্বদাই যুদ্ধ-বিগ্রহে দেশ তখন তোলপাড়.........
*****
একটি রোহিতাশ্ব দ্রুতবেগে রাজপ্রাসাদের দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইল। সামন্ত-রাজ ঈশান দেবের ললাট হইতে রুধির ধারা বহিতেছে। দেহের স্থানে স্থানে ক্ষত, তিনি প্রাসাদে প্রবেশ করিয়া শঙ্কিত কন্ঠে আদেশ করিলেন, 
------কে আছো ! এ রাজ্য পরাজিত হয়েছে, সবাই আত্মরক্ষা করো---
তিনি দ্রুতপদে রাণীর কক্ষে প্রবেশ করিলেন।দেখিলেন রাণী শায়িতা। রাজা তাঁহাকে স্কন্ধে তুলিয়া লইলেন। একহাতে উন্মুক্ত তরবারি লইয়া বাহিরে আসিলেন।

একবার ত্রিলোকেশ্বরের মন্দিরের বন্ধ দ্বারে তরবারি স্পর্শ করিলেন,
-----------হে ত্রিলোকেশ্বর ! তোমার কল্যানে যদি বেঁচে থাকি আবার রাজ্য প্রতিষ্ঠা হবে। তোমার মন্দির প্রতিষ্ঠা হবে, আশীর্বাদ করো ------

অভ্যন্তর হইতে এক অনার্যা নারী আসিয়া পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইলেন। তিনি রাণী পুষ্পা। তাহার কোলে একটি শিশুপুত্র ও চোখে ভয়......
------আমার কি হবে মহারাজ ? আপনার পুত্র.....চন্দ্রদেব.....
ঈশানদেব কিছুক্ষণ থামিলেন, বলিলেন,
------সচিব মহেন্দ্রর সাথে এসো----দ্রুত !!

তিনি রোহিতাশ্বের পৃষ্ঠে আরোহন করিয়া পশ্চিমের পার্বত্য অঞ্চল অভিমুখে দ্রুত বেগে অশ্বচালনা করিলেন। আরো কয়েকজন অশ্বারোহী তাঁহাকে অনুসরণ করিল। তাহারা পশ্চিমের গভীর বনাঞ্চলের দিকে অদৃশ্য হইল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শত্রুসৈন্যের রৈ রৈ শব্দ শোনা যাইল। তাহারা তাড়া করিয়া আসিতেছে-----

****
মহেন্দ্র দেখিলেন ঈশানদেবের দল পশ্চিম দিকে রওনা দিয়াছে। তিনি শিশু চন্দ্রদেব ও অনার্যা রাণী পুষ্পাকে লইয়া সেই দিকে অশ্বপৃষ্ঠে ধাবমান হইলেন। শত্রু সৈন্য তাহাদের অনুসরণ করিল , তাহারা এক অগভীর কিন্তু নির্জন বন্যপ্রান্তরে উপস্থিত হইলেন। পশ্চাতে শত্রু সৈন্য। নিরুপায় হইয়া তাহারা একটি বৃদ্ধ বটের প্রকোষ্ঠে লুকাইলেন। অশ্ব দুটিকে ছাড়িয়া দিলেন। ক্রমশঃ সন্ধ্যা নামিল । তাহারা মধ্যে মধ্যে দূর হইতে
অশ্বখুরধ্বনি ও মনুষ্যকণ্ঠ শুনিতেছিলেন। তাহাও ক্রমশ অস্পষ্ট হইল। বিষাক্ত কীটপূর্ণ বৃক্ষকোটর মধ্যে একটি শিশুকে লইয়া তাহারা নিশ্বাস বন্ধ করিয়া ঈশ্বরকে স্মরণ করিতে লাগিলেন। 

অকস্মাৎ শিশুটি কাঁদিয়া উঠিল। নিস্তব্ধ বনাঞ্চলে ঐ কান্না বহুদূর হইতে শুনা যাইবে, ইহাতে আর আশ্চর্য কি ? পরক্ষণেই কিছু শব্দ বাহিরেও উত্থিত হইল, সুতীক্ষ্ণ একটি ধাতব ফলক সহসা কোটরমধ্যে প্রবিষ্ট হইল। একটি কঠিন কণ্ঠ বলিয়া উঠিল, 
------বাইরে আসুন ! নইলে----
আরোও একটি কণ্ঠ যোগ দিল,
------চল দুদিক দিয়ে তরবারি চালাই-----
মহেন্দ্র ও পুষ্পা শিশুটিকে বুকে চাপিয়া অপর প্রান্ত দিয়া বাহির হইয়া অন্ধকারময় বনপথে ছুটিতে লাগিলেন। শত্রু পশ্চাতে তাড়া করিয়া আসিল----
সহসা একটি ক্রুদ্ধ গর্জন তাহাদের থামিতে বাধ্য করিল। সম্মুখে কালান্তক যমের মতো একটি বিশালকায় ভল্লুক তাহাদের পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইল। দূর হইতে একটি তির আসিয়া পুষ্পার স্কন্ধে বিঁধিল। মহেন্দ্রর বাহুতে বিঁধিল আরোও একটি। 

সম্মুখে ও পশ্চাতে পলাইবার পথ নাই, আহত মহেন্দ্র ও পুষ্পা বসিয়া পড়িলেন। শিশুটি বোধহয় জ্ঞান হারাইয়াছিল। একটি তির ভল্লুকের বক্ষ ভেদ করিবামাত্র ক্রুদ্ধ গর্জন করিয়া ভল্লুকটি শত্রুর দিকে ধাবিত হইল------পুষ্পা ও মহেন্দ্র নিঃশব্দে গুঁড়ি দিয়া অন্য দিকে চলিলেন। তাহারা রক্তাক্ত, শ্রান্ত, তৃষ্ণার্ত। কতক্ষণ চলিয়াছিলেন, কোনদিকে চলিয়াছিলেন, তাহারা জানেন না, সময়ের হিসাব নাই। ঊষা কালে বনের প্রান্তে তাহারা চেতনা হারাইলেন।
*******
এক শ্রেষ্ঠীদল প্রাতে বনপথে যাইতেছিল, তাহারা দেখিল কাহারা যেন পড়িয়া রহিয়াছে, তাহাদের অঙ্গে মূল্যবান পোশাক, শিশুটির বাম বাহুতে ত্রিশূল চিহ্ন -----উহারা আহত মহেন্দ্র, পুষ্পা ও চন্দ্রদেবকে তুলিয়া আনিল। তাহারা দক্ষিনে যাইবে। আহতদেরও লইয়া চলিল। 

রাণী পুষ্পা ও চন্দ্রদেব ঈশানদেব হইতে বহুদূরে চলিয়া যাইতে লাগিলেন। ভাগ্যদেবী তাহাদের লইয়া কি খেলা খেলিতে চাহেন তাহা ভবিষ্যতই জানে। ঈশান দেবও জানিলেন না, তাঁহারই পরিবারের একটি ক্ষুদ্র অংশ মহানদীর অপর পাড়ে পাড়ি জমাইল। 

******
হঠযোগী কথা
******
ঈশানদেব তাঁহার দলবল লইয়া মহাকাল পর্বতের কোলে গভীর বনাঞ্চলে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। হিংস্র পশুর সহিত এখানে কিছু ধীবর,আভীর, শবর, পাটনী, ব্যাধ জাতীয় মানুষের বাস। বনাঞ্চলের পার্শ্বে একটি স্বচ্ছ জলের নদী। নাম ঝুমুর। সত্যই উপলাকীর্ণ ভূমির উপর দিয়া ঝুমঝুম্ শব্দে বহিয়া চলিয়াছে। এখানকার অধিবাসীরা এই নদীটিকে মাতৃ জ্ঞানে পুজা করে। 

প্রাতে উঠিয়া তাহারা দেখিল, দেবপম কিছু মানুষ ঝুমুরের তীরে ইতস্ততঃ পড়িয়া রহিয়াছে। কিছু অশ্ব ঘুরিতেছে। ইহারা কোথা হইতে আসিল, কেনই বা আসিল, কিছুই তাহাদের বোধগম্য হইল না। বহু কষ্টে বুঝিল, ইহারা আহত, বিপদগ্রস্ত। একজন অতি সুদর্শন পুরুষ। তার বাম হস্তের অনামিকায় একটি নীল মণি খচিত অঙ্গুরীয় রহিয়াছে, হয়তো কোনো মূল্যবান রত্ন হইবে। এবং বাম বাহুতে একটি ত্রিশূল চিহ্ন স্পষ্ট। সাথে একজন সন্তান সম্ভবা মহিলা রহিয়াছেন, তাহারও অঙ্গে সুবর্ণময় রত্নখচিত অলংকার। 

ইহারা নিশ্চয়ই কোনো রাজা-রাজড়া হইবেন,তাহারা শুনিয়াছে, রাজারা নাকি এরকম সাজ-সজ্জা করিয়া থাকেন। বিশেষতঃ ব্যবহার অতি মিষ্ট, ভাষাও ভারী শ্রুতি মধুর। তাহারা নবাগতদের গ্রহন করিল। রমনীটিকে উহারা আশ্রয় দিল। কিছুদিন লক্ষ্য করিয়া বুঝিল, ইহারা ভালোই, এবং বুদ্ধিমান । তাহাদের বোধ হইল , ইহাদের দ্বারা উপকারই হইবে। 

*******
ইহাদের আতিথেয়তায় বেশ কয়েকটি দিবস কাটিয়া গিয়াছে। ঈশান দেব একটি পর্ণকুটিরে শায়িত ছিলেন। কিন্তু নিদ্রিত ছিলেন না। তাঁহার সহচরেরা দুইজন করিয়া প্রতিরাতে সজাগ পাহারায় থাকে। এখানে বন্যপ্রাণীর উপদ্রব কম নয়। একটা অদ্ভুত শব্দ ভাসিয়া আসিল দূর হইতে। কান পাতিয়া শুনিলেন ঈশান দেব । একটা ক্রন্দনের শব্দ যেন, তাহার সাথে গম্ভীর মন্ত্র উচ্চারণের শব্দও.......

.....এতো দূর হইতে সঠিক বোঝা সম্ভব ছিল না। ঈশানদেব একজন সহচরকে লইয়া উন্মুক্ত তরবারি হস্তে বনমধ্যে ঢুকিলেন। বন সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ । তাহাদের পায়ের চাপে শুষ্ক পত্র গুঁড়াইয়া যাইবার শব্দ শুধু। আর ঐ মন্ত্রর ধ্বনি। খুব সন্তর্পনে চলিয়াছেন দুইজন ,খানিকটা শ্বাপদের মতো। বেশ কিছুটা অগ্রসর হইয়া নজরে পড়িল, প্রজ্জ্বলিত অগ্নি শিখা। 

(ক্রমশঃ)

1 টি মন্তব্য:

luoman থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.