উপসর্গ

 


"উপসর্গ"

✒  বিকাশ বর


একটা নয়, দু দু'টো লক্ষণ ! দিন দিন ঘাড়ের উপর চেপে বসছে ছিনেজোঁকের মত। গত ছ'মাস ধরে সমস্যা দু'টো বয়ে বেড়াচ্ছে পল্টন দাশ। সমস্যা-- সমস্যায় জীবন জেরবার! বন্ধুবান্ধবদের তার উপসর্গের কথা অনেকবার জানিয়েছে সে। কেউ পাত্তা দেয়নি। বরং সবাই তাকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেছে। বাড়ির লোকজন ফাঁকিবাজ বলে টিপ্পনী কাটে। খাতায় কলমে পল্টন কবে তার আসল নাম হারিয়ে পল্টু হয়ে গেছে, সে মনে করতে পারে না। সমস্যা দু'টো বেশ মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পল্টুর। রাস্তাঘাট, কাজের জায়গায়--বাড়িতে--সর্বত্র যখন তখন উপসর্গ দুটো হুট করে দেখা দিচ্ছে আবার মিলিয়েও যাচ্ছে। আলেয়ার আলোর মত।
যখন সবাই অবজ্ঞায় মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন নিজেকেই নিজের পরিত্রাতা হতে হয়। পল্টু লাট্টুর মত ঘুরতে ঘু্রতে একটা ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে পড়ল। ডাক্তার দেখিয়ে আজ সে বাড়ি ফিরবে। ডাক্তারবাবু সব শুনে একটু যেন গুম হয়ে গেলেন। --"বিপিটা বেশ লো, মনে হচ্ছে এই লোপ্রেশারই প্রথম উপসর্গটার জন্য দায়ী।"-- "দ্বিতীয়টার জন্য কোনো সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখান।" ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে, রাস্তার গাঘেঁসা একটা নিমগাছের নীচে দাঁড়িয়ে পড়ল পল্টু। মাথাটা কেমন ভার হয়ে আছে। সে গত তিনদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে করার চেষ্টা করল। হুবহু সবকিছুই তার মনে পড়ছে। সকাল থেকে ঘুমোনোর আগ পর্যন্ত তার ডেলি রুটিনও সে বেশ স্মরণ করতে পারল। নাঃ, তার কোনো মানসিক সমস্যা নেই। অহেতুক সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গিয়ে লাভ নেই। এতে মেন্টাল প্রেসার বাড়বে। তাছাড়া কেউ জানতে পারলে, রাষ্ট্রময় খবরটা ছড়িয়ে পড়বে। আসলে উপসর্গের কারণটা কেউ ধরতে পারছে না।
পায়ের তলার মাটি হঠাৎ কেঁপে উঠল। ভূমিকম্প ! শরীর দুলে উঠল। মাথাটা টাল খেয়ে গেল। ব্যালেন্স রাখার জন্য নিমগাছটা জড়িয়ে ধরল পল্টু। পথচলতি লোকজনের কোনোদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আশপাশের লোকজনদের মধ্যেও ভূমিকম্পজনিত কোনো প্রতিফলনও নেই ! অথচ সে স্পষ্টকরে ধরতে পেরেছে, ক'এক মুহূর্তের জন্য মাটি কেঁপে উঠেছে। মাসখানিক আগে আশপাশের লোকদের পল্টু জিজ্ঞেস ক‍রতো, ভূমিকম্প টের পেয়েছে কিনা। এখন সে মুখে কুলুপ এঁটেছে। ভুলেও জিজ্ঞাসা করে না। অনেক হাসিঠাট্টার খোরাক হয়েছে সে। আর নয়।
এই আর্থকোয়েক ফোবিয়াই পল্টুর প্রথম উপসর্গ। ডাক্তার লোপ্রেশারকে দায়ী করেছিলেন। পুকুরের জলে ঢেউ খেলছে কিনা, বাথরুমে বালতির জল কাঁপছে কিনা, সিলিংফ্যানটা কী দুলছে--অনেক পরীক্ষা নীরীক্ষা করেছে সে। ভূমিকম্পের ব্যাপারে একরকম নিশ্চিত হয়েছে। সত্যি সত্যিই যে ভূকম্প হচ্ছে কাউকে বোঝাতে পারেনি পল্টু। খবরের চ্যানেলে তার চোখ থাকতো ভূমিকম্পের খবরে। তার অনুভূতির সঙ্গে প্রায় খবরগুলো মিলে যেত --একেবারে সময় মিলিয়ে। দেশের বাইরে, বিদেশে কোথাও না কোথাও ভূমিকম্প হয়েছে। পল্টুর রিখটার স্কেলে ঠিক ধরা পড়েছে !


দ্বিতীয় লক্ষণটা একটু অন্যরকম।
পল্টুর মনে হয়, সবাই তাকে বিশেষ পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে দেখছে। খানিকটা জরিপ করার মত। ছোট বড় , ছেলে মেয়ে --বাসে ট্রামে, রাস্তা-ঘাটে সর্বত্রই সেই জরিপ দৃষ্টি ! সবাই তাকে আড়ালে আবডালে, লুকিয়ে, সামনাসামনি হা পেতে দেখছে। পল্টু বছর সাতাশের ব্যাচেলর। এইচ এস পাশ পল্টু একটা শপিংমলের সেলসম্যান। গড় হাইটের সাধারণ চেহেরা। এতো দেখার কী আছে! অথচ, সবাই তাকে দেখছে। এক বিশেষ দৃষ্টিতে ! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পল্টু সময় কাটিয়েছে। নিজেকে দেখেছে বিভিন্ন অ্যঙ্গেল থেকে। নাঃ, কোত্থাও কোনো অস্বাভাবিকতা তার চোখে ধরা পড়েনি। না সে আগের থেকে অনেক সুন্দর দেখতে হয়েছে, না কোদাকার। কেবল মুখের চামড়া একটু যেন ঢিলে হয়ে গেছে। এতে এত দেখার কী আছে ! পল্টু এই উপসর্গটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারতো। কিন্তু পারছে কই ! সমস্যাটা দিন দিন ঘাড়ে চেপে বসছে। হঠাৎ করে পল্টুর বুকে একটা ভয় চেপে বসল , তাকে কেউ বিদেশী ভাবছে নাতো। বাংলাদেশী না পাকিস্তানী ! তার মুখে কী বিদেশির ছাপ লেগে আছে ! এমন তীর্যকভাবে সবাই তাকে দেখে কেন ! নয়া সিএএ তাকে দেশ ছাড়া করবে নাতো ! সবাই তাকে বিদেশী ভাবছে কী ? এজন্যই কী সবাই এমন করে তাকে দেখছে ? ভয়টা ঘাড় থেকে তার গলায় নেমে এসেছে। শ্বাসনালী টিপে ধরে তার শ্বাসরোধ করে দিচ্ছে সাঁড়াশির মত। বাপচোদ্দপু্রুষের দেশে, নিজের জন্মভূমিতে বিদেশি হয়ে বেঁচে থাকা মৃত্যুযন্ত্রণার সামিল !

পল্টুর বাসটা ঘড়াং করে ব্রেক কসে দাঁড়িয়ে পড়ল। সকাল সকাল বেরিয়েছিল। সিজন্ সেল চলছে। বছরভর ভালো বেচাকেনা হয়নি। এসময় দেরি হলে বস ছেড়ে কথা বলবে না। বাসটার গোঁয়ানো ইঞ্জিন হঠাৎ করে থেমে গেল। ভাতঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন যেন !
পিল পিল করে সার সার মানুষ হেঁটে চলেছে। সেন্ট্রালএ্যভেনিউ আজ মানুষ, যানবাহন আর মিছিলের সঙ্গমস্থল। লম্বা লেজবিহীন মিছিল এগিয়ে চলেছে। কতক্ষণ ঠায় বসে থাকতে হবে তার ঠিক নেই ! বাস থেকে নেমে পড়ল পল্টু। পায়ের তলায় মাটি একটু যেন কেঁপে উঠল। আবার ভূমিকম্প ! দাঁড়িয়ে পড়ে টালটা সামলে নিল সে। চলমান স্রোত থেকে কথাটা শুনল, সামনে কোনো এক রাজনৈতিক দল সিএএ, এন আর সির বিরুদ্ধে রাস্তা অবরোধ করেছে। বাতাসে স্লোগান ভেসে আসছে--"নো সিএএ, নো এনআরসি, উই ওয়ান্ট জব, উই ওয়ান্ট ডিমোক্রাসি"। ভিড় ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে পল্টুর বুকটা ধক্ করে কেঁপে উঠল। এই একটা সুযোগ আছে তার দ্বিতীয় উপসর্গটা তাড়ানোর। কেউ আর তাকে তীর্যক দৃষ্টিতে দেখবে না। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে আর যেতেও হবে না। হঠাৎ টিয়ারগ্যাসের সেল ফাটল। মানুষজন যে যেদিকে পারে ছুটছে। জনতার ছত্রভঙ্গ ! পল্টু অবোরোধ মঞ্চের দিকে এগিয়ে চলেছে। পুলিশ মাইকে ঘোষণা ক‍রছে- "আপনারা শান্ত হোন। যে যেখানে আছেন দাঁড়িয়ে পড়ুন। সিএএর স্বপক্ষে অবোরোধ বিরোধী একটা মিছিল এম জি রোড ধরে এগিয়ে আসছে--- যে কোন মুহূর্তে সংঘর্ষ বেঁধে যেতে পারে ! আপনারা শান্ত হোন। সহযোগিতা করুন। আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। আমরা মিছিল আটকানোর চেষ্টা ক‍রছি। অকারণ উত্তেজনা ছড়াবেন না।" মাইক, জনতা, মিছিল পুলিশ-- পতাকা ফেস্টুন-- পল্টু সাময়িক দিশেহারা হয়ে গেল যেন। একটু থেমে আবার সে পা চালাল জোর কদমে। মঞ্চের কাছে গিয়ে একজনের হাত থেকে একটা প্ল্যাকার্ড ছিনিয়ে নিল সে। আকাশ ফাটানো গলায় চিৎকার ক‍রে সে স্লোগান তুলল,--"নো সিএএ, নো এনআরসি। উই ওয়ান্ট ডিমোক্রাসি"। পল্টুর সেই বজ্র স্লোগানে হাজার হাজার কন্ঠ সমবেত হল। --"নো সিএএ, নো এনআরসি--"
হঠাৎ একটা আধলা ইট বাতাসে উড়ে এসে পল্টুর মাথায় এসে পড়ল। রক্ত ধারায় ভাসতে ভাসতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল পল্টু।
আয়লার মত, টাইফুনের মত, বাঁধ ভাঙা মানুষের স্রোত আকাশ কাঁপিয়ে, বাতাস দাপিয়ে ছুটে চলেছে পল্টুকে মাড়িয়ে, ভেঙে গুড়িয়ে চুরমুর করে। পল্টু দেখল, কেউ তার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। কারো চোখে সেই তীর্যক দৃষ্টি নেই। কারো গলায় স্লোগানের আওয়াজ নেই। কেমন নির্বাক- নিথর। তার পায়ের তলার মাটি আর কেঁপে উঠছে না।

1 টি মন্তব্য:

luoman থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.