আমার গল্প


 

"আমার গল্প"

✒অদিতি দে


ভাবছি ডায়েরি  লিখব কিনা,  তিন বছর আগের কথা, ডায়েরি লেখা যায় নাকি... তারচেয়ে বরং গল্প লিখি...আমার গল্প!


তিনবছর আগে,২০১৭ সাল। এস এস সি দিলাম। প্রায় এক মাস ছুটি কাটানোর পর সবাই ইন্টারের পড়া আড়ম্ভ করার জন্য কোচিং এ দৌঁড়াতে লাগলো। আমারও দৌঁড় শুরু হলো। 

আমিও দুজন বান্ধবীর কাছে শুনে গেলাম, অংক কোচিং ছিলো সেটা।কি নাম স্যারের, মনে নেই।

বাবা নামিয়ে দিয়ে এলো চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের সেই সর্বজনবিদীত কোচিং সেন্টারের যায়গায়।


দেড়িতে পৌঁছালাম।

তখন স্যার কথা বলছেন। আমি ক্লাসে ঢুকলাম।বসার জায়গাই নেই! একদম শেষে একটা চেয়ারে বসলাম। পরে যাওয়ায় সবাই ঢোকার সময় তাকিয়ে ছিলো।

বসে সামনে তাকাতে ছেলেদের মধ্যে একটা ছেলেকে পিছন দিয়ে চেনা লাগলো!  ভালো করে তাকাতেই বুঝলাম ছেলেটি রাফি! দুবছর আগের তিন চার মাসের একটা ছোট্ট অতীত।


তখন ক্লাস এইট।রিয়াদ স্যারের কোচিং। এক সপ্তাহ মামারবাড়ি কাটিয়ে ফিরে এসে একদিন  যেতে দেড়ি  হওয়ায় ৪ নং বেঞ্চে বসেছিলাম। মেয়েদের আর ছেলেদের সাইড আলাদা! ছেলেদের সাইডের ২ নং বেঞ্চে বসা একটা ছেলের ফোল্ড করা জামার হাতা আর সেই হাতে একটা ঘড়ি হঠাৎই কেন যেন চোখে লেগে যায়!

এমন নয় যে আমি ঘড়ি সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞানী, ভালো ঘড়ি দেখে চোখে লাগলো! 

না। এম্নিই! কারণবিহীন!  তখনও আমি তার মুখই দেখিনি!


আস্তে আস্তে একদিন মুখ দেখলাম।


অন্য একদিন নাম জানলাম।


রাহাত ইসলাম রাফি।


রোল ও জেনেছিলাম, ভুলে গেছি।সরি, দেখেছিলাম। ওরই একটা বই এ। স্যার মেয়েদের  সাইডে বইটা নিয়েছিলেন।

ছেলেটি মুসলমান।

সাধারণত পছন্দ করা ব্যক্তি অন্য ধর্মের জানতে পেলে মানুষ বিচলিত হয়।আমি হলাম না। আমার কোনো চিন্তা ই ছিলো না! প্রতিদিন যেতাম, ক্লাস করতাম, মাঝে মাঝে সুযোগ হলে তাকিয়ে দেখতাম।চলে আসতাম।

জীবনে প্রথম ভালোলাগা একটা অন্য অনুভূতির সৃষ্টি করে। অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করে সব কিছুর প্রতি। আমি বুঝতে পারলাম কিছু পরিবর্তন হচ্ছে।আমি খুশি ছিলাম। ভীষণ খুশি। আর কিছু চিন্তা করার কথা ভাবিইনি।

কথা বলতেও আগাইনি!

ক্লাস এইট, জে এস সি কোচিং, ৭/৮ মাসের কোচিং এ প্রায় এক দেড় মাস কোচিং করার পর ছেলেটাকে খেয়াল করেছিলাম। আর মাত্র কয়েকমাস যা ছিলো, শুধু দেখেই গেছি। না কথা, না অন্য কোনো যোগাযোগ প্রচেষ্টা।

না, আমি একাই দেখেছি তা নয়। কয়েকদিন আমার তাকা তাকির পর ছেলেটিও বুঝেছিলো একটা মেয়ে তাকাচ্ছে।তারপর সেও তাকাতো।চোখে চোখ পড়লেই সরিয়ে নিতাম।


হাহা, ছেলেমানুষী আর কি!  আমার  ছেলেমানুষির প্রমাণ আরো আছে।একবার ছেলেদের খাতা মেয়েদের  দিয়ে  দেখানো আর মেয়েদের খাতা ছেলেদের  দিয়ে দেখানোর  সময় আমার খাতা ওর কাছে আর ওর  খাতা আমার কাছে চলে এসেছিল। সেদিন নাম লিখতে হয়েছিল। আমি ওর খাতায় আর ও আমার খাতায় নাম লিখেছিল।  আমি সেই খাতার ওর নাম লেখা দুপাতা এইট-নাইন-টেন-ইন্টার যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম আমার ডায়েরির ভাজে!


রাফির কাহিনি ক্লাস এইটেই শেষ হয়ে গেছিলো। কোচিং শেষ। কাহিনি শেষ। লাস্ট দিন অব্দি শুধু তাকানোই। এরপর কখনো  আজকের আগে দেখা হয়নি।

তবে হ্যাঁ, রাফির কাহিনি জড়িয়ে অন্য ছেলে এসেছিল।

অনুপ দে।

মোমিন গার্লসের শিক্ষার্থী আমি তখন, বাবা একই স্কুলের শিক্ষক। বাবা শিক্ষক থাকাকালীন স্কুলে পড়া মানুষ ই এ জ্বালা বুঝবে। কখন কোন স্যার,কোন ম্যাম,কোন ভুলের জন্য বাবার কাছে গিয়ে নালিশ জানায় আবার!বাবার স্কুলে পড়ার ভয়  সেই শুরুতেই পেয়ে গেছিলাম। একটা ঘটনা, ক্লাস থ্রি, সবে চান্স পেয়েছি মোমিন গার্লসে, প্রথম দিন ক্লাস ছিল। এক দুই ক্লাস পরে ম্যাম আসেনি। আমাদের মনিটর বানানো হয়েছিল রিনা আর নোভাকে। ওদের উপরে আদেশ ছিল কাউকে যেন রুম থেকে বাইরে যেতে না দেওয়া হয়।আমি আর আমার প্রাইমারি স্কুলের বান্ধবী তুশি লাস্টের দিকে বসেছিলাম ।হঠাৎ আমার টয়লেটে যেতে হবে।রিনা কে ডাক দিলাম, বাথরুমে যাব। না করে দিল, বাইরে যাওয়া যাবে না। কিন্তু আমার  প্রয়োজন গুরুতর... কয়েকবার  বললাম কোনভাবে শুনল না।

পাশে বসে থাকা তুশি হঠাৎ বলল আরে তুই স্যারের মেয়ে, ওদেরকে বলছিস না কেন?

আমি রিনা কে আবার ডাকলাম, আবার বললাম, ফল হলো না। পাশ থেকে তুশি বলে উঠলো আরে ও অর্ণব স্যারের মেয়ে, যেতে দাও নাহলে সমস্যায় পড়বে।রিনা বেচারী ভয় পেয়ে  আমাকে ছেড়ে দিল, সাথে তুশি। সেদিন বাথরুম সহ পুরো স্কুল  ঘুরে তাই ক্লাসে ফিরেছিলাম।


বাড়ি ফিরে  ঘাড় আর পেটের কাছে  দেখলাম ফুসকুড়ির মত। মাকে দেখাতে মা চোখ কুঁচকে দেখতে লাগলো। অবশেষে বাবাকে ডাক দিয়ে বললঃপক্স না?দুজন মিলে  দেখে বলল হ্যাঁ,পক্স।আমার হওয়ার পরে আমার ভাইয়ের হলো। সাত কি আট দিন পর আমার  পক্স ছাড়লো। ডাবের জল, দুধ দিয়ে স্নান  করানো হলো। পরদিন আবার ক্লাসে গেলাম, নাম ডাকা শেষে ক্লাসটিচার নুপুর ম্যাম আমাকে নাম ধরে দাঁড় করালেন।

~ তোমার বাবা স্কুলে আছে বলে কি তুমি বিশেষ সুবিধা পাবে বলে মনে করেছ??

আমি হতভম্ব। হলো টা কি? ম্যামের দিকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। সারা ক্লাস আমার দিকে তাকানো। ম্যাম বলতে লাগলেন... ওদেরকে তুমি কি বলেছ? তোমার বাবা স্কুলের টিচার  তাই বলে তারা তোমাকে কিছু বলতে পারবে না?  তুমি মনিটরের কথা শুনতে বাধ্য না? তুমি কি জানো এই কথা যদি আমি এখন অর্ণব দাদাকে  গিয়ে বলি তাহলে তোমার অবস্থা কি হবে??

এইটুকু বয়সে এইসব চিন্তা মাথায় আসে কি করে? তোমার বাবা স্কুলের টিচার বলে তুমি কোনো বিশেষ সুবিধা পাবে না,ঠিক আছে? তুমিও বাকি সবার মত।

আমি চুপচাপ শুনতে লাগলাম, শুনতে শুনতে একবার রিনার দিকে তাকালাম,মেয়েটা হাসছে,নিশ্চিত মনে করেছে, বিশাল জব্দ করেছে! কিন্তু কথা হলো এখানে আমার কোন দোষই নাই। প্রথমত, আমি বাবার কথা বলিনি! দ্বিতীয় ত  বাবা আছে এই সুবিধা নেব তা মাথায় আসে নি কখনো, বরং বাবা আছে এই নিয়ে আরো ভয় পেয়ে এসেছি!   হঠাৎ ম্যামের সাথে কথা বলতে আসলেন কেউ একজন। আমি চুপচাপ বসে পড়লাম। কথা শেষ করে সে চলে গেলে, ম্যাম আবার আমাকে ডেকে বললেন,আমি তোমাকে বসতে বলেছি??মরার উপর খাড়ার ঘা!আমি আবার কিছু কথা শুনলাম।  মূল যে দোষী সে চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। সেদিন মূলত রিনার উপর আমার রাগ হয়েছিল না। হয়েছিল তুশির উপর। মেয়েটা কেন বলতে গেল! কিন্তু যাই হোক, স্কুলে বাবা থাকার পরিনাম আমি ভালোভাবে জেনে গেছিলাম।


বান্ধবী ছিলো একটা, তন্দ্রা।

মেয়েটিকে আমার ভালো লাগতো। গায়ের রঙ কালো। ভালো ই কালো। একটু আধটু নয়।  মেয়েটি শ্যামাসুন্দরী। দেখলেই মানুষ স্বীকার করবে যে সুন্দর। অন্তত আমার তাই মনে হতো।

একদিন কথায় কথায় ওকে কিছুটা ইচ্ছে করেই প্রায় বলি আমি একটা ছেলেকে পছন্দ করছি।

পিছনে লেগে পড়ে কে তা শোনার জন্য। আমি অনেক ইতস্তত করার পর বলি কোচিং এরই একজন।কথা নেওয়ায় আর কাউকে যেনো না বলে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "কেউ কথা রাখেনি" এর মত তন্দ্রা ও কথা রাখেনি! ১০ মিনিট পর নোপা, নীপালি যার ভালো নাম, আমরাই নোপা নাম দিয়েছিলাম, এসে ধরা শুরু করলো, অরুণা বল ছেলেটি কে?

আমি রাগ করি, বিশেষ কিছু বলিনা।

কিন্তু নোপা চুপ থাকার মেয়ে না। সে খুঁজে বের করতে শুরু করলো কে হতে পারে।

তথ্য দুটো,কোচিং,একই ব্যাচ।

খুঁজে ও বের করলো, কোচিং এ ওই ব্যাচে দুটো হিন্দু ছেলে,যাদের পছন্দ করার মতো। 

আমি হিন্দু। নোপা ভাবেওনি, কোনো মুসলিম কাউকে আমি পছন্দ করবো।

যে দুটি ছেলে ছিলো তাদের একজন,নীল। নোপার প্রেমিক। তাই অপর জন খুব সহজেই মনে করে নেওয়া হলো!অনুপ দে।

নোপা এতেই থামলো না।নীলকে দিয়ে অনুপকে জানালো আমি তাকে পছন্দ করেছি। অনুপ উত্তর দিলোঃ এখন ত পড়ার চাপ! এসব এখন না। পরে ভাববো।আমি এসবের কিছুই জানতাম না। অনুপ দে নামে ছেলে আছে একটা তা অব্দি না।

যখন জানলাম, তখন রাগে ফেটে পড়লাম! সাথে ভয়েও।রাগ এই কারণে যে আমি ত বলিনি আমার এতো উপকার কর!

ভয় এই, বাবা যদি জানে! কেউ যদি বলে! আমি ত শেষ!

নোপার সাথে তুমুল ঝগড়া করলাম, ক্লাসে বসেই। মেয়েটা হাসতে লাগলো আর বললোঃ আরে তুই ভাবিস কেনো! কে স্যারকে বলবে? কিন্তু ছেলেটি যে অনুপ না তাও আমি বলতে পারিনা কারণ তাহলে আবার প্রশ্ন জাগবে কোন ছেলে।

পড়ায় প্রভাব পড়লো এসবের জন্য। প্রচুর অমনোযোগী হয়ে গেলাম।

যাহোক, মনে মনে আমি অনুপ ছেলেটিকে ধন্যবাদ দিলাম, না' করার জন্য। কারণ সে হ্যাঁ করলে আমি অন্য ঝামেলাতে ফাঁসতাম।

নোপা পরে সরি বলেছিলো। সে ঘটনা সেখানে সমাপ্তি। এইট শেষ হলো। রেজাল্ট খারাপ করলাম। মন খারাপ ছিলো। নাইনে উঠে কদিন পার হতেই নোপা একদিন হঠাৎ আমাকে বললো "অরুণা কিছু কথা বলবো।রাগ করিস না যেনো। অনুপ তোর সাথে একটু কথা বলতে চায়।কোনো একদিন রাত ১২ টার পর যদি কথা বলিস বা যেকোনো সময় স্কুলের পর যদি দেখা করিস।"আমি খেপলাম।আবার। প্রথমত ছেলেটিকে আমি পছন্দ করিনি। খেয়ালই করিনি ঠিকমতো।দ্বিতীয়ত,বাবা যদি জানে!?আমি না করলাম।নোপা বললো,আচ্ছা আমি সামলে নেবো।ক্লাস টেন আসলো।  আবার একদিন বলল, অরুণা ছেলেটা কেবল একবার কথা বলতে চাচ্ছে। আমি না করলাম৷ ইচ্ছুক নই। মনে করছিলাম ম্যাটার শেষ।  কিন্তু না।আজ কোচিং এসে দেখলাম,কেবল রাফি না, অনুপও আছে!


আমি ঠিক করলাম দৃঢ়ভাবে,ছেলেদের সাইডে তাকাবোই না।কলেজে উঠে প্রেম করবো না।আগে ইন্টার। ভালো যায়গায় চান্স পেতেই হবে। এম্নিও আমি খুব খারাপ শিক্ষার্থী ছিলাম না। পড়লে পারে টাইপ।

যাহোক আমার সংকল্প অটল।

কোচিং যেতাম সাইকেলে। এইট থেকেই সাইকেল চালাতাম। যেতাম,কোচিং করতাম,বাড়ি ফিরতাম। একদিন মৌমিতার  সাথে এক কোনায় বসে গল্প করছিলাম।  হঠাৎই মৌমিতা আমাকে বললো দেখতো অরু ওই ছেলেটিকে, পদবী "রায়", তোরা ভাইবোন নাকি?বা আত্মীয়?

আমি তাকালাম। দেখলাম। এক সেকেন্ড তাকিয়ে যা দেখলাম তাতে মাথায় কেবল একটা কথা এলো, ছেলেটি সুন্দর।

আমি বললামঃ আরে না। চিনিই না।এম্নিই ত অনেকের পদবি একই থাকে।

তারপর অন্য কথা। আমি আর তাকাইনি। মনেও রাখিনি। তারপর এক দিন দুদিন পর, হঠাৎই একদিন খেয়াল করলাম, কেউ তাকাচ্ছে, ছেলেদের মধ্যে থেকেই!

মেয়েদের জন্মগত ক্ষমতা সম্ভবত এটা যে, কেউ নজর দিলে  তারা বুঝতে পারে। তারমানে এই নয় যে ব্যতিক্রম থাকবে না। কিন্তু প্রায় ৯৫%  ক্ষেত্রেই মেয়েরা বোঝে! এম্নিই বোঝে।

আমিও বুঝলাম।

ভাবলাম তাকায় তাকাক, আমার কি।

কিন্তু আমি কিছু না করাতে ছেলেটা তাকানো বন্ধ করলো না!

একদিন দুদিন সে তাকাচ্ছেই।আমি বিরক্ত হলাম।ভাবলাম খুঁজে বের করি কে তাকাচ্ছে কারণ আমি আমি চেহারা দেখিনি। বের করতে গিয়ে দেখলাম মৌ এর দেখানো সেই ছেলেটি!আমি সত্যিকার অর্থেই অবাক হলাম।কারণ ছেলেরা তাকালে সাধারনত  মেয়েরা ভাবে হয়তো ছেলেটি পছন্দ করেছে।আমিও তাই ভেবেছি কিন্তু গন্ডগোল  সেখানেই! ছেলেটি আমার থেকে হাজারগুনে বেশি সুন্দর।

আমাকে দেখে ক্রাশ ত খাওয়া সম্ভব না,তাইলে!!?


যদি কোনো সুন্দর ছেলে একটা সাধারণ মেয়ের দিকে তাকায় তখন যা মনে করা হয়ঃ ১) ছেলেটি প্লেবয়,সুন্দর অসুন্দর সবাইকে লাইন মারে

২)বিশাল ভালো টাইপ,চেহারা গুরুত্ব রাখে না তাই প্রেমে পড়েছে।

প্রেমে পড়া ছাড়া আর কোনো কিছু আমি মনে করিনি কারণ সেরকম কোনো লক্ষণ ছিলো না।সে তাকাতো,কেবলই তাকাতো।একদিন দেখলাম,বাইরে বের হওয়ার সময় ওয়েট করছে,আমি বুঝলাম আমি যাচ্ছি না কেনো তা বুঝতে চাচ্ছে।

স্যারের সাথে কথা ছিলো, বাসায় পড়াবেন কিনা।বলতে গেলাম।ফিরে এসে দেখি..


 (২)


ফিরে এসে দেখি চলে গেছে সে। তারপর, বাসার টিচার ঠিক হলো। আমি ওই কোচিং যাওয়া বন্ধ করলাম।

আর দেখা হলো না।


দুদিন পর অন্য কোচিং নিতু ম্যামের কাছে পড়তে গেছিলাম। ম্যাম পড়াচ্ছে। ছেলেমেয়ে আসছে। হঠাৎই ছেলেটি এলো। তাকিয়ে চমকালাম। চোখাচোখি হলো। চোখ সরালাম। খুশি ছিলাম আর দেখা হয়নি। কিন্তু আবার হলো, অস্বস্তি তে পড়লাম।সে ঢুকলো। কাছেই গিয়ে বসলো। পড়ানোর একটা সময়ে ম্যাম একটু বিরতি দিলে অন্য ছেলেদের সাথে কথা বলার সময় প্রথম কন্ঠ কানে এলো ছেলেটির। হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে যাচ্ছিলো।  সম্ভবত গরুও এর চেয়ে ভালো স্বরে হাম্বা ডাকে!

অবশ্য বুঝেছিলাম, বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন এর কারণে হয়েছে।কিন্তু সত্যি হাস্যকর। শুনলেই হাসি পেতো।


কোচিং শেষে, আমি এরকটু দেড়িতে নিচে নামতে চাইলাম যাতে সবাই চলে যায়, ছেলেটিও।কিন্তু, দেড়িতে নেমেও দেখি, সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! আবারও বিরক্ত হলাম।সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে দেখলাম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে!

একদৃষ্টিতে একটা ছেলে তাকিয়ে থাকলে  অস্বস্তি লাগে। ওর চোখ, মনে হচ্ছিলো আমার ভেতর অব্দি দেখে নিচ্ছে!যদিও, তাকানো খারাপ ছিলোনা। চোখ দেখলে বোঝা যায় একজন কোথায় তাকাচ্ছে।আমি ওকে তাকাতে যতবারই দেখেছি কেবল মুখই দেখতে দেখেছি। দৃষ্টি লোলুপ নয়।

কিন্তু আমার তাতে কি তখন? আমি বিরক্ত।

এমনভাবে নেমে সাইকেল বের করলাম যেনো আমার পাশে যে ৫'১১" এর একটা খাম্বা দাঁড়িয়ে আছে আমারই দিকে তাকিয়ে, আমি তা দেখিইনি। অস্তিত্ব ই জানিনা!( হাইট টা তার কাছ থেকে পরে জেনেছিলাম, আর হ্যাঁ,সে খাম্বাই,লাইটপোষ্টের সমান,গায়ে মাংস নেই,কারণ বাড়িতে খেতে পাই না।)

গেট থেকে বের হয়ে ভাবলাম, সাইকেলে উঠলে ছেলেটিও সাইকেলে পিছু নিয়ে বিরক্ত করতে পারে।

আমি বুদ্ধি করলাম, হাঁটা ধরলাম সাইকেল একপাশে নিয়ে।মৌ আর ওর মা হেঁটে যাচ্ছিলো। আমি ও তাদের সাথে হাঁটছি,সাইকেল নিয়ে।

খুশি খুশি লাগছে,ছেলেটা নিশ্চ৩ চলে গেছে এতক্ষণে। কিন্তু সামনে দিয়ে ত গেলোনা!

আচ্ছা, দেখিতো, পিছন দিয়েই গেছে নিশ্চয়ই।

আমি পিছনে তাকালাম। সাথে সাথে ৪২০ ভোল্টের ঝটখাও খেলাম! ছেলেটিও সাইকেল নিয়ে হাঁটছে! পিছু পিছু আসছে!!

হায় ভগবান!  এ কি জ্বালা!আমার বিরক্তি এবার রাগে পরিণত হলো।

সাথে একটা জিনিসও বুঝলাম যে, আমি যে ছেলেটিকে তাকাতে দেখেছি এবং এড়িয়ে যাচ্ছি তা এ  বোঝেনি।

অবশ্য আমি বোঝায়নি তাই বোঝেনি।


সাধারণত ছেলেরা মেয়েদের খেয়াল করলে মেয়েরা বোঝে।বুঝে তারা দুটো কাজ করে।

১) পছন্দ হলে সায় দেয়, আস্কারা দেয়

২) অপছন্দ হলে এড়িয়ে যায়।

কিন্তু ছেলেরা বোঝে না যে মেয়েটা এড়িয়ে যাচ্ছে।তারা ভাবে মেয়েটা বোধহয় কানা! তাকে দেখতেই পাচ্ছেনা! প্রকৃতি নারী পুরষের অনুভবের পার্থক্য রেখেছে বটে।


আমি পিছনে তাকালে চোখাচোখি হলো।  ত্বড়িৎ গতিতে চোখ সামনে নিলাম কিন্তু পিছনে তাকানো টাকে ছেলেটা সিগনাল ভাবলো!  আমি বুঝলাম সে আগাচ্ছে, জোরে পা চালাচ্ছে।

ঠিক করলাম এবার বুঝিয়ে দেবো যে আমি বুঝেছি তুমি তাকাচ্ছো কিন্তু আমি আগ্রহী নই।

ছেলেটি কাছে এসে কথা বলতে গেলেই আমি পা দ্রুত চালালাম।সামনে তুশি হাঁটছিলো।ওর সাথে হাঁটা ধরলাম।স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলাম আমি দেখেছি কিন্তু চাচ্ছি না।

ছেলেটি একটু চমকে গেছিলো কিন্তু বুঝেও ছিলো আমি কি বুঝিয়েছি।আমি দেখলাম সে আর পিছু নিচ্ছে না। সাইকেলে উঠে বাড়ি গেলাম খুশি মন নিয়ে।যা চেয়েছি তাই হয়েছে।

পরদিন কোচিং এ গেলাম। ছেলেটি এলো কিন্তু আর তাকালো না। আমি খেয়াল করলাম স্পষ্টভাবেই সে তাকানো বন্ধ করেছে। হাঁফ ছাড়লাম। যাক বেঁচে গেছি।সাথে ভালো ও লাগলো জিনিসটা যে ছেলেটি বুঝেছে এবং আমার অনিচ্ছাটাকে সম্মান জানিয়েছে।

সেদিন প্রজেক্টর দেখানোর জন্য ম্যাম দেয়ালে দেখাবে। যেখানে ওরা বসে। প্রথম বার একটা দেখালো।ওরা উল্টো হয়ে দেখলো।দেখতে সমস্যা হওয়ায় পরেরবার উঠে বাইরে যেতে গিয়ে ঘা লাগলো আমার পিঠে। অনিচ্ছাকৃত ছোঁয়া, লাগার সাথেই বুঝলাম।

ফেরার পথে আবার লাগলো, তবে আগেরবারের তুলনায় কম। সে চেস্টা করেছে যাতে কম স্পর্শ লাগে,আমি বুঝলাম।

জিনিসটা ভালো লাগলো।

ছেলেটা খারাপ নয়।


জানলাম নাম তীর্থজিত রায় তূর্য।

শুধু চেহারার কথা বললে,ছেলেটি সুন্দর, এক সেকেন্ড দেখলেই যাকে সুন্দর বলা যায়, সেরকম সুন্দর,  একবার দেখলে আরও দুবার দেখতে ইচ্ছে করার মতো সুন্দর।কিংবা বলা যায় আমার সেরকম লেগেছিলো। লম্বা,  চিকুন। এতো ই চিকুন যে পাটকাঠি বলা বেটার। কন্ঠটা গরুর হাম্বার সাথে তুলনাযোগ্য তবে গরুটা অপমান বোধ করবে।ফর্সা, প্রয়োজনের অধিকই ফর্সা। কথা বলে হাত নাড়িয়ে, দেখলাম।মেয়েদের সাথে মেশে বেশ, মৌ এর কাছে থেকে বই নিলো।

মৌ কে আমি চিনি, খারাপ মেয়ে না। ওর সাথে ভালো সম্পর্ক মানে ছেলেটিও খারাপ হওয়ার কথা নয়।


নিতু ম্যামের পর ইংরেজি নিলাদ্রী স্যারের কোচিং শুরু হলো। তীর্থ এটা সেরে ওতেও যেতো। মনে আছে, একদিন, স্যারের কোচিং এ দেড়ি করে পৌঁছালে দেখলাম সে দাঁড়িয়েছে, আমিও ঢুকলাম, চোখাচোখি হলো। কিন্তু, সে আর একইভাবে পিছু নেয় না।কথা বলতে চেস্টাও করেনা। আমি তাতে খুশিই।


ক্লাসে দেখলাম অমনোযোগী হয়ে বসে আছে বাইরে তাকিয়ে। হঠাৎই স্যার হাসির একটা কথা বলায় সকলে হেসে উঠলো,আমিও... তীর্থ চমকে তাকালো আমার দিকে।আমার পিছনে ছিলো কিন্তু আমি স্পষ্ট ই দেখেছি।অবাক হলাম!

কোচিং শেষে রাস্তায় যেতে দেখি একপাশে দাঁড়িয়ে সম্ভবত কারো অপেক্ষা করছিলো ও।

আমি দ্রুত চালালাম, সাইকেলে পার হয়ে এলাম। কিন্তু দেখলাম শেষ অব্দি তাকিয়ে দেখলো।

চলে এলাম বাড়ি। পরদিন থেকে ছেলেটিকে আর দেখলাম না। কোথাও না!আমিও ভুলে গেলাম। ব্যস্ত হয়ে গেলাম নিজের পড়াশোনা তে।মনেই ছিলো না।


এরমধ্যে একদিন ফেবু একাউন্ট খুললাম, লুকিয়েই।(ফেসবুক কে  ফেবু বলা তার কাছ থেকেই শিখে ছিলাম)কলেজ চয়েস দেওয়া হলো কিছুদিন পর।

প্রথম চয়েসেই এম এম কলেজ চলে আসলো। ভর্তি দিনে কলেজ গেলাম।ভর্তির ফর্ম পূরণ করতে গিয়ে দুটো ছেলেকে একইসাথে দেখলাম। অরণ্য ঘোষ, ফারহান হোসেন। ফারহান ছেলেটা সুন্দর,চিকুন,লম্বা হয়তো ৬ ফুট। ফর্ম জমা দিতে যাওয়ার সময় হঠাৎই দূর থেকে একটা ছেলেকে দেখলাম,

তীর্থজিত!

আমি দেখলাম, প্রায় ৫০ হাত দূরত্ব থেকে, তাও চোখাচোখি হলো। আমি চোখ সরালাম, সরিয়েও বুঝলাম তাকিয়ে আছে। তবে তা অল্পক্ষণ। সরিয়ে নিলো। আমরা ফর্ম জমা দেওয়ার জায়গায় গেলাম। বাবা আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ফর্ম জমা দিতে গেলো অরুণ দাদুর সাথে।

আমি একা দাঁড়িয়ে। অরুণ দাদুর ছেলে স্বপ্ন,অরণ্য, ফারহান আরও কয়েকটি ছেলে দাঁড়িয়ে ছিলো। 

ছেলেদের সাথে মিশি কম বরাবরই। আমি উল্টোদিক ফিরে দূরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ হাসির শব্দ শুনে  পিছনে ফিরে দেখি তীর্থজিত,স্বপ্নের সাথে গল্প করছে, হাসছে, কখন এসেছে জানিও নি।

কিন্তু খেয়াল করলাম, কন্ঠের উন্নতি হয়েছে। হাম্বা ডাক ডাকছে না এখন। হাসি পেল মনে করে।

আমি আবার উল্টোদিক ফিরলাম, একটু পর পিছন ফিরে দেখি উধাও! কেউ নেই। বাবা ডেকে নিয়ে গেলো। সাথে চললাম, কেন জানি ছেলেটাকে খুঁজতেও শুরু করলাম। আবার দেখতে মন চাইলো যা আগে যতবার দেখেছি একবারও মনে হয়নি!

দেখলাম দূরে দাঁড়িয়ে আছে, ছেলেদের সাথে, মেয়েদের সাথে কথা বলছে। দেখতে ভালো লাগলো কেন জানি!


ভর্তি হলাম, বাড়ি চলে আসলাম।দুপুর গেলো, রাত হলো। পড়তে বসলাম। মন বসলো না । তীর্থজিত এর কথা মাথায় আসছিলো। আসার মতো কিছুই হয়নি কিন্তু আসলো!  দিন গেলো।  কিন্তু ওই চিন্তা মাথার থেকে গেলো না। আমি পড়তে পারছিলাম না। ভালো লাগছিলো না কিছুই। একটা ভালো লাগা কাজ করছিলো।

কলেজ শুরু হলো।  ওরিয়েন্টেশন এর দিনে মেঘের,ভালো নাম মেঘবতী, পাশে বসে,ইন্টারে ওঠার দরুন বাড়ি থেকে বাবার ব্যবহার করা ভাংরী ফোন যেটাতে তীর্থর কয়টা ছবি সেভ করা ছিলো, দেখায়ে বললাম দস্ত, ছেলেটাকে ভালো লাগে,দেখ ত একটু।মেঘ দেখে বললো হ্যাঁ,ভালো। আর কিছু বলতো,তার আগে বাড়ি ফিরে যেতে হলো।

ক্লাস শুরু হলো। একদিন কলেজ শেষে ইংরেজি কোচিং এ মৌ, রুকসানা দের কথা শুনছিলাম। তীর্থজিতকে নিয়েই বলছিলো। আমি জানতে পারলাম, সেন্ট জোসেফ কলেজে চান্স পেয়েছে তাই এখন ঢাকাতে।বাবা কেবিন ক্রু, মা এঞ্জিও কর্মচারী। এক ভাই এক বোন।বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। যশোর নীলগঞ্জ শ্মশান এ মন্দিরের পাশে বাড়ি।

শুনে ইন্টারেস্টিং মনে হলো।

যেকোনো মেয়ে একটা ছেলে পছন্দ করতে হলে কিছু জিনিস দেখে, সাধারণ ভাবেই দেখে।

১) ছেলে কেমন

২)পরিবার

৩) ভাইবোন কয়টা

১) ছেলেটিকে আমার ভালো লেগেছিলো তখনই যখন আমি এড়িয়ে যাচ্ছি বোঝানোর পর সে আমার সাথে কথা বলা বা পিছু নেওয়ার চেস্টা আর করেনি।

টাচের ক্ষেত্রেও ভালো লেগেছিলো। খারাপ হলে ইচ্ছে করে ছুঁতো, সেটা সে করেনি। তাকিয়েছে কিন্তু তাকানোতে লোলুপতা ছিলো না।ছাত্র ভালো জেনেছিলাম, সেন্ট জোসেফ এ চান্স পেয়েছে সেটাও কম নয়।

২) পরিবার ভালো লেগেছিলো কারণ বাবা মা চাকরি  করে। যার মা কর্মজীবি সে ছোটবেলা থেকে কর্মজীবী নারীকে সম্মান করার মানসিকতা নিয়ে বড় হবে সেটা আশা করা যায়।আমি জীবনে বিয়ে করি বা না করি চাকরি অবশ্যই করবো, আমার তাই সেইদিকে সাপোর্টিভ মানুষ পছন্দ।

৩) বোন বড় এবং বিয়ে হয়ে গেছে। তার মানে আর ভাইবোন নেই।অর্থাৎ ননদ নেই,ভাসুর নেই,দেওর নেই।ঝামেলা নেই। এই চিন্তা শুনতে খারাপ লাগতে পারে কিন্তু অমূলক নয়।


এগুলো ভেবেছিলাম কারণ, ছেলেটিকে ভালো লেগেছিলো। অর্থাৎ এট্রাকশন কাজ করছিলো। আমি জানতাম যে এটা কেবল ভালো লাগা।

প্রায় দেড় মাস পার হলো। আমি মনে করেছিলাম ছেলেটির কথা আবারও ভুলে যাবো। কিন্তু এবার ভুললাম না। কেন জানি মনে পড়তে থাকলো।

পড়ায় ব্যাঘাত ঘটতে থাকলো। ভাবলাম একটা কাজ করি।  ম্যাসেজ দেই ফেসবুকে। যেই ভাবা সেই কাজ।


কিন্তু কি বলে ম্যাসেজ দেবো? কথা ত চাই!

বাবা ইংলিশ কোর্স করেছিলো সেন্ট জোসেফ থেকে নিজের চাকরি পাওয়ার সময়। সেন্ট জোসেফ থেকে নাকি টোফেল করা যায়। বাবা টোফেলের গল্পও করে।আমি ভাবলাম টোফেল নিয়ে কথা বলি। ম্যাসেজ রিকুয়েষ্ট দিলাম।

হাই,

আমার একটু দরকার ছিলো।

~ হেলো, আপনি কে?

#আমি অরুণা রায়, আমার একটু কথা ছিলো তোমার সাথে।

~হ্যাঁ বলো।

#আমার এক দিদি আছে, তিনি সেন্ট জোসেফ  থেকে টোফেল করবেন।চাকরি নেওয়ার জন্য লাগবে। তুমিকি একটু বলতে পারবে কিভাবে করে বা এই সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবে কিছু? আমি বলেছিলাম আমি জানিনা কিন্তু তিনি মানতেই চাচ্ছেন না।

~ বুঝলাম না, টোফেল টা কি?

# আছে, আমি জানিনা বলেই ত তোমাকে বল্লাম

~ আমিও জানিনা।

#ওহ,আচ্ছা।


কনভারসন থেমে গেলো।  আমিও আর কিছু বলার খুঁজে পেলাম না।

ওইভাবেই রেখে দিলাম!

ছুটি এলো,সম্ববত ঈদের, গ্রামে গেলাম বেড়াতে।তীর্থ এলো যশোরে,নিজের বাড়িতে।গ্রামে, আমার  কাকার মেয়ে, নিলু দি যাকে মেঝদি বলি, ও আমার চেয়ে এক বছরের বড়ো, তখন ইন্টার সেকেন্ডিয়ারে,তালা সরকারী কলেজে।দিদির সাথে দিদির ঘরে কথা হচ্ছিলো। হঠাৎ, দিদি ফোনে একটা ছেলেকে দেখিয়ে বললোঃ দেখ, একে

আমিঃ কে? বয়ফ্রেন্ড ?

~হা হা, হ্যাঁ

কি বলিস! কবেরতে??

~এইতো কয়েকমাস, চিনি প্রায় একবছর।ছেলেই প্রপোজ করেছে।

বাহ!! প্রেমও করে ফেলছিস!কর।

কেন জানি কি মনে করে এলিনরে দিয়ে অন্য ঘরের তে আমার ব্যবহার করা তখনকার ফোনটা আনালাম।তীর্থর ছবি ছিলো। বেশ কিছু ফোনে সেভড।দিদিরে দেখালাম,

দিদিঃ হুউ,সুন্দর। বয়ফ্রেন্ড নাকি?

আমিঃ না রে, আমি পছন্দ করি।

~ত বলেছিস?

আমিঃ না না, পাগল নাকি!

~ ত বলে দে! কথা বলেছিস?

আমিঃধুর বলা যায় নাকি! কথা হয়েছে, একদিন।

আমি বুঝিইনা কি নিয়ে কথা বলবো!

~ আচ্ছা আমারে দে, আমি চ্যাট করছি।

আমিঃ সিরিয়াসলি?  আচ্ছা নে।


চ্যাটঃ

দিদি(আমার ফোন থেকে)ঃ হাই, কি খবর?

তীর্থঃ এইতো ভালো ই, তোমার

দিদিঃ ভালো, কি করা হচ্ছে?

~ সন্ধ্যার নাস্তা করি

দিদিঃ নাস্তাতে কি খাও

~ বিস্কুট, তুমি কি করো

দিদিঃ বসে আছি, বিস্কুট ছাড়া আর কিছু খাও না?

তীর্থঃ নাহ! গরীব মানুষ


দেখি কি লিখেছিস..  বলে কেড়ে নিলাম ফোন, দিদি বললোঃ বলে দে যে পছন্দ করিস।

~ধুর,কদিন দেখেছি! তাছাড়া, কি ভাববে!

দিদিঃ কিছুই ভাবার নাই। ভেবে দেখ, আগ্রহ থাকলে বলে দে। তুমি না বল্লে অন্য কেউ বলবে।


আমি চুপ হয়ে গেলাম,"অন্য কেউ" শব্দটা সহ্য হলো না কেন জানি। বলা কি ঠিক হবে? কিভাবেই বা বলা যায়! সামনে বললে বেটার হয়! সামনে কিভাবে পাবো?দেখাও ত করতে বলতে পারি না!

আরও দুদিন পর যশোর ফিরলাম, ছুটি শেষ, আমি যশোর ফেরার সম্ভবত পরদিনই তীর্থ ঢাকায় ফিরেছিলো।আমার অবস্থা আমি সামলাতে পারছিলাম না।মন বসানো যাচ্ছিলো না।কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো। নিজের উপর রাগ হচ্ছিলো। আমি সাধারণত কোনো কিছুর উপর নির্ভরশীল হই না! ছোট থেকেই, থাকলে থাকো,নাইলে যাও এটিটিউডে বড় হওয়া আমি! তাইলে এই ছেলে কেন!!!


নিজের উপর রাগ বাড়তে লাগলো!  কি করবো বুঝলাম না। না পেরে অবশেষে ঠিক করলাম, আচ্ছা বলেই দেই।  দিলে নিশ্চিতভাবেই না করবে! পড়ে সেন্ট জোসেফে!যশোরের মেয়েকে গার্লফ্রেন্ড নিশ্চয়ই বানাবে না!নিশ্চয়ই ছেলের পছন্দ আর চাহিদা বেশি হবে খুব। কিন্তু, না করার পরে নিজের দাম বাড়ানোর  জন্য যদি সবাইকে জানিয়ে বেড়ায়?আমি লজ্জাতে যে মরে যাবো!!


পড়লাম দ্বিধায়! বলা কি ঠিক হবে? কিন্তু, নিজেরে সামলানোও মুশকিল,আমার পড়াশোনা হচ্ছে না। ঠিক করলাম, বলবো যে পছন্দ করি।না করে দিক।আমার মাথা অন্তত শান্ত হবে।যদি দাম বাড়াতে বলে বেড়ায় ই,তাইলে নাক কাটবে,তাছাড়া ত আর কিছু নয়? অপরাধ ত আর আমি করে ফেলবো না! যাহোক, কিভাবে বলবো? উম্ম, কাগজে লিখি,টেক্সট করা ভালো দেখায় না।

কাগজ নিলাম, লিখলামঃ

"Tirthojeet, 

I Like You. 

ভালো না লাগলে, "না" করতে পারো,ব্লক করতে পারো, কিন্তু প্লিজ কাউকে জানিও না। তোমাকে প্রায় সবাই চেনে, আমি খুব লজ্জায় পড়ে যাবো।"


পাঠাবো করবো কিনা আধাঘন্টা ধরে তাই নিয়ে দ্বিধায় ভোগার পর,অবশেষে ম্যাসেজ দিলামঃ

হাই

~হেলো

আমি একটা কথা বলবো তোমাকে।

~কি কথা, বলো।

 পাঠিয়ে দিলাম! কাগজটার ছবি তুলে।

হাত কাঁপছিলো!  নিজেরে দেখে নিজেই আশ্চর্য হচ্ছিলাম!  ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর ইগো আমার! জেদের সাথে প্রচন্ড আত্মসম্মানবোধ। একবার কেউ একটু বাজে ব্যবহার দিলে সে রাস্তায় দ্বিতীয়বার হাঁটি না আমি।আমার মতো মেয়ে একটা ছেলেকে স্পষ্ট প্রপোজাল পাঠিয়ে, তার হ্যাঁ এর অপেক্ষায় কাঁপছে!!!

ছেলেটা সীন করলো। নস্টালজিয়া তৈরি হলো আমার।কি রিপ্লাই দেবে?

                                                        

(৩)


রিপ্লাই আসলো, প্রায় আধাঘন্টা পর।

~এটা তুমি লিখেছো?

আমিঃ হ্যাঁ

~নিজের লেখা? নাকি কপি করেছো?

আমি ছেলেটার সেন্স অফ হিউমার দেখে হতভাগ হয়ে গেলাম!  একটা মেয়ে প্রপোজাল দিয়েছে! এর লেখা কপি না পেস্ট করা তা কোন কামে লাগবে????কি ছেলে এ! 

আমিঃ নিজের লেখা,কেবল লিখলাম

~ও আচ্ছা! মনে হলো যেনো কোথাও লেখা টা দেখেছিলাম তাই

আমিঃও, উত্তর কিছু দিবা না?

~এখনই লাগবে? মানে চিনি না ত, মিশিনি

আমিঃ তাইলে কিভাবে?

~ মিশি আগে কিছুদিন? সমস্যা? 

আমিঃ আচ্ছা!

~ কিছু ভুল বল্লাম কি?

আমিঃ না না না

~ তোমার পুরো নাম কি?

আমিঃঅরুণা রায়

~ এম এম কলেজে পড়ো ত?

আমিঃ হ্যাঁ। 

~ বাড়ি কোথায়?

আমিঃঘোপে।

~ বাড়িতে কে কে আছে?

আমিঃ বাবা, ভাই, আমি, মা

~ওহ, আঙ্কেল কি করেন?

আমি এবার বিরক্ত হলাম! প্রথম দিনেই মানুষ এভাবে ইন্ট্রো কিভাবে নেয়! ছেলেটার ব্যবহার আমাকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলো,এভাবে প্রপোজাল পেয়ে এ অভ্যস্ত না, এমনকি, সম্ভবত প্রপোজাল পাওয়ার পর মেয়ের সাথে কথা বলতেও অভ্যস্ত না।আমার হাসি পেলো।

আমিঃ মোমিন গার্লস এর টিচার।

~ তুমিও ত মোমিনের?

আমিঃ হ্যাঁ 

~ ওহ, তোমার কোনো ডাক নাম নেই?

আমিঃ না,বান্ধবী কয়জন অরু ডাকে।কেন?

~ আসলে,তিন অক্ষর ত, লিখতে সময় বেশি লাগবে,তাই।

আমিঃ সেক্ষেত্রে, তুমি নিজস্ব ডাক নাম তৈরি করে তাই বলে ডাকতে পারো।

~তাই নাকি!?আচ্ছা! উম্ম,কি দেওয়া যায়?

আমিঃ তিন অক্ষরে তোমার সমস্যা, নাম আমি কেন ঠিক করব?তাছাড়া,অরু ডাকতে পারো।সবাই ডাকে।

~ না,সবাই ডাকে বলে এটা আমার পছন্দ না।আমি একা একটা ডাকবো।

আমিঃ ত,সেটা কি?

~আচ্ছা,ভাবতে হবে কাল বলবো।


প্রথমে বেরসিক লাগলেও শেষের কথায় আমার ভালো লাগলো। আমি দেখলাম ছেলেটা নিজের থেকে কিছু প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আমার সাথে মেশার।জিনিসটা ভালো লাগলো। সাধারণত, মেয়েরা এদেরকে পছন্দ করে।


আমিও করেছিলাম।

আমার ডাকনাম হিসেবে নীলা ঠিক করেছিলো সে।নামটা আর নীল রং ও নাকি তার প্রিয় তাই ভেবেচিন্তে ওই নাম।তীর্থর সাথে আমার প্রতিদিন কথা হতো। প্রায় সারাদিন ই।নীলা বলেই ডাকতো।  ছেলেটা ভালো ই ছিলো। আমার সাথে মেশার জন্য নিজস্ব ইচ্ছা আর চেষ্টা দেখাতো যা আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করতো। আমরা প্রায় ৮ মাস মতো মিশেছিলাম।৮ মাসে সে আমাকে সেই "পছন্দ করি" বলে পাঠানো ম্যাসেজের উত্তরে হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বলেছিলো না।হয়তো আরও কিছুদিন মিশলে বলতো,কারণ আমরা সুন্দর ভাবে একে অপরের সাথে মিশে গেছিলাম। আমি পছন্দও করতাম ছেলেটিকে,ব্যাপার আগে যেতেই পারতো।

নিয়তি তা হতে কোথায় দিলো!ওইসময়ে হঠাৎ  মা অসুস্থ  হলো। মা এর সমস্যা আগে থেকেই।যশোর, ঢাকা,কলকাতা সবই দেখানো হয়েছে।এবার সমস্যা হলে কলকাতা থেকে বলেছিলো ডাক্তার, চেন্নাই নিয়ে দেখাতে।আমাদেরকে যেতে হলো। বাবা,আমি, ভাই ও মা।আমার তখন ইয়ার ফাইনাল চলছিলো। পরীক্ষা না দিয়েই আমি ইন্ডিয়া তখন।ডাক্তার দেখানো হলো। মা কে ওখানে এডমিট করে নিলো।প্রায় দেড় মাস পর বাড়ি ফিরতে পারলাম আমরা।

মা কিছুটা সুস্থ।মাথার সমস্যার জন্য কারেন্ট শট দিতে হয়েছিলো  ডাক্তারকে।বাবা রাজি ছিলো না।কিন্তু রাজি হতে হয়েছিলো  কারণ এই ছাড়া নাকি আর রাস্তা নাই! সব মিলিয়ে মা বাড়ি আসার পরও যথেষ্ট দুর্বল।সব কাজ আমাকেই হাতে নিতে হলো। ভাই সত্যিই কপাল করে জুটেছিলো আমার।পুরো টা সময় আমার সাথে সমানে সাহায্য করেছে।


কিন্তু, সাহায্য করলেও আমার পরিবারের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ত আর টিকে ছিলো না! ইন্টারের পড়ার চাপ,এম এম কলেজের সপ্তাহ পর পর মাসিক পরীক্ষার চাপ,বাড়ির কাজ সব করে তীর্থের সাথেও সময় কাটানোর সুযোগ কোথায় অবশিষ্ট ছিলো আমার জন্য!?

কথা বন্ধ করে দিয়েছিলাম কিংবা বলা ভালো বন্ধ হয়ে গেছিলো। তারপর আর তার সাথে কখনো কথা হয়নি।ইচ্ছে ছিলো কিন্তু আগাতে পারিনি।সময় অনুকুলে ছিলো না।যদিও মায়ের সমস্যার কথা আমি তাকে জানিয়েছিলাম না।পরে সেও আর খোঁজ নেয়নি।


ওই দুমাসে পড়াশোনাতে যে গ্যাপ পড়েছিলো তাই সামলাতে আমাকে ইন্টারের পরীক্ষা আসার আগের দিন অব্দি পরিশ্রম করে যেতে হয়েছে।অন্যদিকে তাকানোর সময়ই পাইনি!পরীক্ষা শেষে প্রশ্ন আর বইখাতা নিয়ে হিসাব নিকাশ কষে দেখলাম রেজাল্ট কেমন হতে পারে।বুঝলাম প্লাস নিশ্চয়ই আসবে।গোল্ডেনও হতে পারে।এক সপ্তাহ পর বাবা ডেকে বললো রেজাল্টের চিন্তা ছাড়ো আর ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নাও। আবার আরেক সংগ্রাম! কোচিং এ ভর্তি হলাম দুই যায়গায়। একটা ভালো করে করার জন্য এবং অন্যটাতে পরীক্ষা দিতে।

কোচিং এর মেয়াদ প্রায় পাঁচ মাস ছিলো। দুই যায়গাতেই মোটামুটি ছিলাম।স্যার রা প্রশংসা করতো। সেই পাঁচ মাসের কোচিং এ একটা ছেলের সাথে পরিচয় হলো, যে পরিচয় জীবনের অন্যতম এক অভিশাপের নাম হয়ে রয়েছে আমার আজ অব্দি!


ছেলেটিকে আমি একটা ডাক নাম দিয়েছিলাম।

প্রত্যুষ।নামটা আমার ওই সময়ে অন্যতম প্রিয় একটা নাম ছিলো। আসল নাম প্রদোষ শীল।

এখন মনে পড়লে মাঝে মাঝে ভাবি যে কাউকে তার নাম বাদ দিয়ে নিজস্ব কোনো ডাকানাম যা আবার প্রিয়ও, দেওয়া উচিত না! কারণ,যদি সেই ব্যক্তির প্রতি কখনো ঘৃণা জন্মায় তখন আপনি দু-দুটো নাম আজীবন ধরে মনে করতে চাইবেন না।সেই নামধারী ব্যক্তির সাথে কাজ করতে চাইবেন না! সেই নাম নিজের ছেলেমেয়ের নাম হিসেবে কখনো রাখবেন না।

দিনশেষে ক্ষতি কিন্তু সেই নিজেরই! সেইসব মানুষের কিছুই যাবে আসবে না।তাই কি দরকার খামাখা ফাও বেকার নামগুলো নষ্ট করার?

আমাকেই দেখুন,যতদিন বাঁচবো নাম দুটো মনে করলেও ঘৃণাতে মন বিষিয়ে উঠবে!অথচ কাহিনি কেবল তিনটে মাসের!


প্রত্যুষ একই কোচিং এ আসতো। আমাদের ব্যাচ এমনকি ব্যাচের দিন অব্দি আলাদা ছিলো,আমার ব্যাচের থেকে পড়াশোনা ওর ব্যাচে প্রায় সপ্তাহ খানিক এগিয়ে ছিলো। সে সকাল ৭-৯ টার ব্যাচে, শনি-সোম-বুধ আর আমি দুপুর ৩-৫ টার ব্যাচে,রবি-মঙ্গল-বৃহঃস্পতি। আমাদের দেখা হওয়ার সামান্যতম সম্বাবনা ছিলো না, কিন্তু, হা হা,কপাল বলেও যে একটা কিছু আছে দুনিয়ায়! মনে আছে,তখন কোচিং শুরু করার কেবল মাসখানি হয়েছিলো... একদিন আমি যথারীতি কোচিং করতে গেছি আমার সাইকেলে।ও হ্যাঁ, আমার প্রথম কেনা জেন্টস সাইকেল ছেড়ে ততদিনে আমি লেডিস সাইকেল চালানো শুরু করেছি।নিজের ইচ্ছেতেই কেনা ছিলো। যাহোক, কোচিং এ ছিলো সেদিন সারপ্রাইজ পরীক্ষা।সপ্তাহে যেকোনো দিন নেওয়া হতো কিন্তু হঠাৎ করে। সেইদিনের সেই হঠাৎ পরীক্ষা শেষে উত্তর পত্র জমা দিয়ে প্রশ্নের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একদমই ভালো দেইনি। নিসন্দেহে, কম পাওয়ায় বাড়িতে বাবার নাম্বারে কল যাবে।কোচিং এ বসেই পাশে থাকা মেয়েদের সাথে প্রশ্ন সলভ করতে লেগে গেলাম।কিন্তু, পরের ব্যাচের পরীক্ষাও আছে।আমিতো ইচ্ছে করলেই বসে থাকতে পারিনা। যাদের সাথে মেলাচ্ছিলাম,একজন বললোঃ চলো,রিকশা উঠি,বাড়ি যেতে যেতে পুরো প্রশ্ন সলভ হয়ে যাবে।

আমি উঠে গেলাম।প্রশ্ন সলভ করে বাড়ি ফিরে স্নান সেরে খেতে বসলাম,মা বললোঃ আসার সময় শব্দ হলো না যে? অন্যদিন ত ভেঙেচুরে আসিস মনে হয়!


সাথে সাথে মনে পড়লো, আরে আমার সাইকেল!!!ভুল করে রেখে এসেছি! মা বললো এখন ত প্রায় অন্ধকার হতে চললো, না,এখন যাওয়া যাবে না।কাল সকাল হলে গিয়ে নিয়ে আসিস। প্রথম ব্যাচ কটায়?

~৭ টায়

আচ্ছা,সকালে গিয়ে নিয়ে আসিস।এখন দরকার নেই।


আমি হিসেব মতো পরেরদিন সকালে উঠেই সাইকেল আনতে দৌঁড়ালাম। সাইকেল নিতে গিয়ে দেখি আমারটার উপর আরও পঞ্চাশ টা রাখা! ছেলে মেয়েরা এসে গেছে।ক্লাস শুরু। আমি পৌঁছাতে দেরি করে ফেলেছি।কিভাবে বের করবো বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে ভাবছি,ঠিক তখনই সাইকেল নিয়ে এলো একটি ছেলে হন্তদন্ত হয়ে।উপরে ক্লাস শুরু যে।তাড়া অনেক।কোনোমতে সাইকেল রেখেই উপরে উঠে গেলো। আমি অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি! দুমিনিট পর দেখলাম যে ছেলেটা উপরে গেছিলো সে হঠাৎ আস্তে আস্তে নীচে নেমে এলো! নিচে নেমে বেজার মুখে এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে আমার দিকে তাকালো।আমি বল্লামঃ সাইকেল টা বের করে দিতে এক্টু সাহায্য করবে? আমি একা পারছি না।


সে মনে হয় আশা করেছিলো না হঠাৎ করে আমি কথা বলে উঠবো। আমার দিকে এক্টু হা তাকিয়ে থেকে তারপর এগিয়ে এলো।

~তোমার সাইকেল?  তুমি চালাতে পারো?

*হ্যাঁ, আমার।পারি বলেই ত সাইকেলে এসেছি।

~এতো পিছনে গেলো কিভাবে তাইলে?তোমাকেও বের করে দিয়েছে?

* না না।আমি কালকের ব্যাচের।ভুল করে রেখে গেছিলাম।কিন্তু, আমাকেও মানে? তোমাকে বের করে দিয়েছে?

~হ্যাঁ। দেড়ি হয়েছে তাই।

*ওহ! ত এখন? কি করবে?

~কি আর, বাড়ি যাবো। তুমি কোন দিকে যাবে?

*আমি ঘোপের দিকে।

~চলো একসাথে বের হই।কাজ ত আর কিছু নাই।


যেতে যেতে পরিচয় হলো। বাড়ি আমার স্কুলের পাশেই প্রায়।বাবা সরকারি চাকরি করে।একমাত্র ছেলে,মা গৃহিনী।সাধারণ আলাপ।বাড়ি ফিরে এসে পড়তে বসে গেলাম।আর দেখা হওয়ার কথা ছিলো না।কিন্তু হলো। এক সপ্তাহ পর কোচিং এ গিয়ে দেখলাম আমার ব্যাচে ক্লাস করতে এসেছে।ক্লাস শেষে ডেকে কথা বললো। সেদিন বাড়ি ফেরার পর নাকি বাসায় কিছু সমস্যা হয়েছিলো তাই ক্লাস করতে পারেনি এই এক সপ্তাহ। পিছনে পড়ে যাওয়ায় আমার ব্যাচে শিফট হয়েছে। তারপর থেকে,আমার ব্যাচেই পুরোপুরি চলে এসেছিলো। ক্লাস করতাম।মাঝে মাঝে রুটিন বা পড়া জিজ্ঞাসা ইত্যাদি জানার জন্য কল দিতো।আমিও কখনো দিতাম।যাওয়ার সময় একসাথে সাইকেলে বের হতাম। প্রায় চৌদ্দ/পনেরো দিন পর একদিন কোচিং থেকে যাওয়ার সময় রাস্তায় বললো অরু কিছু কথা বলতাম।

* হ্যাঁ, কি বলবি? আজকের পড়াটা কি জোস বলছিলি।স্যার খুশি হয়েছেন।

~না, একটু অন্য বিষয় এ!

*কি?

~আসলে সাইকেলে থেকে এভাবে বলা যায় না।এক্টু দাঁড়াবি কোথাও?....

 (৪)


~আসলে সাইকেলে থেকে এভাবে বলা যায় না।

*কি এমন বলবি!? বাসা অনেক দূর ত আমার, সময় লাগবে ত। আচ্ছা সামনে দাঁড়াচ্ছি।


ছায়া দেখে দাঁড়ানোর পর ছেলেটা বলেছিলো,অরু,তোর ব্যাচের একটা মেয়েকে না ভালো লাগে,তুই মিশিস ও,দীপা।তুই কিছু সাহায্য কর না আমাকে। আমার রাজি না হওয়ার বিশেষ কারণ ছিলো না।আমি বললাম কি করতে হবে?

~আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দে সাধারণ ভাবে।তারপর দেখছি।

পরিচয় করিয়েছিলাম। কিন্তু, পরিচয় করাতে গিয়ে ছেলেটার প্রশংসা যেটুকু করেছিলাম, সেটাই পরে কাল হয়ে দাঁড়ালো! যেদিন দীপা আর প্রত্যুষ পরিচিত হলো তার দুদিন পরের কথা।কোচিং এ পৌঁছাতে একটু দেড়ি হওয়ায় দ্রুত ক্লাসে ঢুকেই যায়গা নিয়ে বসে সামনে তাকাতে গিয়ে দেখলাম সবাই আমার দিকে তাকাচ্ছে! কি ব্যাপার? সামনে স্যার আছেন, সাথে দীপার বাবা এবং দীপা, প্রত্যুষ দাঁড়িয়ে!  ভয় পেলাম,ছেলেটা না জানি কি করেছে!


স্যার আমাকে দাঁড় করালেন।

~তোমার সমস্যা কি? এখানে ক্লাস করতে আসো? নাকি অন্যকিছু???

সমস্ত ক্লাস হা করে তাকিয়ে।আমি বুঝিইনা আমি কি করেছি!সেদিন ঝাড়ি শুনেছিলাম স্যারের কাছ থেকে,দীপার বাবার কাছ থেকে,নিজের বাবা এবং মায়ের কাছ থেকে!সাথে অতিরিক্ত পুরস্কার হিসেবে দীপার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কেরও ইতি।ঘটনা কি? পরে জেনেছিলাম, প্রত্যুষ দীপাকে পরেরদিনই প্রপোজ করেছিলো।দীপা যথারীতি না বলেছিলো।সমস্যা সেটা না, সমস্যা হলো না শুনে ছেলে থামেনি।তার পুরুষত্বে আঘাত লেগেছিলো। মেয়েটার পিছু নিয়ে বাড়িতে গিয়ে তার বাবাকে বলেছিলো,আংকেল, অরুণাকে চেনেন ত? ও  আমার ছোটকালের বান্ধবী,ও ই আমাকে দীপার সাথে পরিচয় করিয়েছিলো। আমি ভালো ছেলে।আপনার মেয়েকে দেখে ভালো লেগেছে। ও কে হ্যাঁ করতে বলুন।নাহলে, আমার আরও বন্ধুবান্ধব আছে,আপনাদের সমস্যা হতে পারে।


এই বক্তব্যের ফলস্বরূপ দীপার বাবা কোচিং এ অভিযোগ করে আমার নাম সহ!আমি বিনামূল্যে সুন্দরভাবে গেলাম ফেঁসে। কিন্তু, কথা হলো, আমি যেটুকু প্রত্যুষের সাথে মিশেছিলাম আমার অন্যরকম লেগেছিলো! ওই ঘটনার পর শুনেছিলাম, প্রত্যুষের বাবা বড় পোস্টে চাকরি করেন,ক্ষমতাও অনেক।ছেলে ইচ্ছেমতো বড়ো হয়েছে।তাই এই অবস্থা। কোচিং থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিলো। ওর বাড়িতে খবর পাঠিয়েছিলো,বাবাকে বলেছিলো।দীপার বাবার কাছে ওর বাবার ক্ষমা অব্দি চাইতে হয়েছিলো। আর আমার অবস্থা এই যে, আমার দোষ নেই তা কেউ বিশ্বাস করলো না।কোচিং এ সবাই দেখেছে আমাদের একসাথে মিশতে।সাইকেলে যেতে।বাড়িতে বাবা বললো পড়াশোনা বাদ দিয়ে দাও মেয়ে।ওসবের আর দরকার নেই তোমার।ছেলে টেলে খুঁজি।রিকশা, ভ্যানআলা  কেউ হলেই হয়ে যাবে।


এখন অব্দি জীবনে এর থেকে বেশি ঝামেলাতে আর আমি পড়িনি!অবশ্য এই কথাটা আমার বলা উচিত না।মাত্রই এতটুকু বয়স আমার!জীবন ত সবে শুরু, তাই না?আরও কত ক আসবে।ওই ঘটনার রেশ বহুদিন ছিলো বাড়িতে।তবে হ্যাঁ, কাউকে প্রেমে সাহায্য করতে যাবেন না! নিজে প্রেম করলে তৃতীয় ব্যক্তিকে আনতে যাবেননা।প্রত্যুষের সাথে সুন্দর একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিলো যার শেষ টা এতো জঘন্যভাবে ঘটলো সবার গালাগালি শুনে যে, আবার হঠাৎ রাস্তায় সামনে পেলে নিশ্চিত ইট ছুড়ে মাথায় মাড়বো! ছোটকালে ভাড়া বাসায় থাকাকালীন আমাদের উপরের ফ্লাটে একটা ছেলে ছিলো। তখন আর বয়স কত হবে আমার...ছয়/সাত।ছেলেটার নাম ছিলো রুদ্র।ওর আরও দুই দিদি ছিলো। বিকেল হলে সারা ফ্লার্টের ছেলেমেয়ে একসাথে ছাদে হৈ-হুল্লোড় চলতো।রুদ্র আমার থেকে এক বছরের বড়ো ছিলো। আমাকে দিয়ে দাদা বলে ডাক দেওয়াতে চাইতো আর আমি নাম ধরে ডাকতাম।ছেলেটা রাগে ফুলে যেতো,বড়ো সবার কাছে নালিশ জানাতো,দেখো আমি বড়ো, আমাকে নাম ধরে কেনো ডাকবে!?সেসব দেখে আমি হাসিতে লুটিয়ে পড়তাম।খুব সাধারণ একটা দৃশ্য, সাধারণ ঘটনা।কিন্তু এখনো মনে পড়লে সমান অনুভূতি থাকে,এখনো হাসি পায়!কদিন পর ওরা ইন্ডিয়া চলে গেছিলো। এখন মনে পড়লে ভাবি যে, যদি রুদ্র এখানেই থাকতো, আমাদের প্রতিদিন দেখা হতো, কথা হতো, তবে হয়তো আজ ছোট্টবেলার হাসির কাহিনি মনে না পড়ে অন্য তিক্ত ঘটনা মনে পড়তো!

কেউ কেবল তখনই সবচেয়ে ভালো মানুষ মনে হয় যখন তাকে কম জানা হয়।দূর থেকে তাজমহল ও সুন্দর লাগে,খুব কাছে গিয়ে দেখবেন সৌন্দর্যেও দাগ চোখে পড়বে...!


কোন মন্তব্য নেই

luoman থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.