আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে (দ্বিতীয় অংশ)
"আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে (দ্বিতীয় অংশ) "
✒ সমীরণ সরকার
কলেজ স্ট্রিটে পুরনো জায়গাগুলোতে ঘুরতে ঘুরতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছিল । কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য মাথায় নিয়ে সোমনাথ কোথাও ঘুরছিলেন না ।শুধু পুরনো দিনের অনেক স্মৃতি ক্রমাগত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল তাঁকে। আর তাই সেই পুরোনো জায়গাগুলোতে তিনি কোথাও একটু দাঁড়াচ্ছিলেন, কোথাও বা সুযোগ থাকলে একটু বসছিলেন। কফি হাউসে গেলেন। এক কোণে কিছুক্ষণ বসলেন। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন ।না,পুরনো কাউকে দেখতে পেলেন না তিনি। সব নতুন মুখ। এত বছর পরে পুরনো কাউকে দেখতে পাওয়ার কথাও নয় ।তবুও মনের মধ্যে একটু খানি আশা ছিল যদি কাউকে দেখতে পাওয়া যায়। যদি কেউ হঠাৎ তাকে দেখে চিৎকার করে ওঠে ,এই সোম, কেমন আছিস ?
কিন্তু না, সে রকম কিছু ঘটল না। কিছুক্ষণ পরে তিনি কফি হাউস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন পৌনে দুটো বাজে।ও বাবা, অনেক লেট হয়ে গেল তো !সবাই চিন্তা করবে ।খবর দেওয়ার জন্য পকেট থেকে মোবাইলটা বার করলেন ।কিন্তু না, অনেকবার চেষ্টা করেও লাইন পেলেন না ।
একটা ট্যাক্সি ডাকলেন। একটু তাড়াতাড়ি যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
যুবক ড্রাইভার বলে,উপায় নেই স্যার ।এখন সব রাস্তা ওয়ান ওয়ে হয়ে গেছে ।ঘুরে যেতে সময় লাগবে ।
----বেশ, যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি চালান ।
ভালোই যাচ্ছে ট্যাক্সিটা। এভাবে চললে মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যে পৌঁছে যাবেন শ্বশুরবাড়ি ।মনে মনে ভাবলেন সোমনাথ। অনেকটা ঘোরাঘুরি হয়েছে। একটু ক্লান্তি বোধ করলেন।
সোমনাথ মাথাটা এলিয়ে দিলেন সিটের পিছনে। চোখটা বোধহয় একটু লেগে এসেছিল ।হঠাৎ হইচই এর শব্দ শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল তাঁর ।ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে গেছে।
সোমনাথ জিজ্ঞাসা করলেন ড্রাইভারকে ,কি হলো, দাঁড়ালেন কেন?
------ মনে হচ্ছে সামনে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।
---- তাহলে? কী করবেন এখন? একটু উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করেন সোমনাথ।
---- একটু দেখি না স্যার, তারপর ভাবা যাবে ।----------কিন্তু আমার যে একটু তাড়া ছিল!
----- আমি কি করব স্যার ?দেখলেন তো কত তাড়াতাড়ি চালিয়ে এলাম।
---- হুম।
প্রায় মিনিট দশেক সময় কেটে গেল। সামনে ভিড় কমার লক্ষণ তো নেই ,উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।
সোমনাথ বললেন ,আমি কি একবার নেমে একটু দেখে আসব?
------ কোন লাভ হবে না স্যার। মনে হয় এক্সিডেন্টের পরে পাবলিক অবরোধ করেছে রাস্তা।
----- তা হোক ,একবার দেখে আসি একটু।
------ ঠিক আছে স্যার।
সোমনাথ গাড়ির গেট খুলে রাস্তায় নামলেন ।পায়ে পায়ে এগিয়ে চললেন ভিড়ের দিকে।
যেতে যেতে শুনলেন, লোকজন বলাবলি করছে যে, একজন পথচারী মহিলা মিনি বাসে চাপা পড়েছে। দুটো মিনিবাস নাকি অনেকক্ষণ ধরে রেষারেষি করছিল ।মহিলা একটা মিনিবাসে ছিলেন। তিনি স্টপেজ এ মিনি বাস থেকে নেমে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই পিছনের মিনি বাস তাকে চাপা দিয়ে বেরিয়ে চলে যায়। মহিলা সম্ভবত স্পট ডেড ।জনতা মহিলার বডি ঘিরে রেখে রাস্তা অবরোধ করেছে। পুলিশের কাছে দাবি তুলেছে, ঘাতক মিনি বাসের চালক কে অবিলম্বে অ্যারেস্ট করতে হবে। যতক্ষণ না এরেস্ট করা হচ্ছে ড্রাইভারকে, জনতা নাকি বডি ছাড়বে না
এবং রাস্তা অবরোধ তুলবেনা বলে জানিয়েছে ।ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলেন সোমনাথ। দুর্ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছে জনতা। সোমনাথ যথেষ্ট লম্বা তবু সামনের কয়েকজন লোককে সরিয়ে দিয়ে ,তিনি একটু এগিয়ে মাথা বাড়িয়ে দিলেন।
আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আকস্মিক শক খাওয়ার মত চমকে উঠলেন তিনি। রাস্তার উপরে কে পড়ে আছে?একাকে দেখছেন তিনি? না না , এ অসম্ভব !এটা হতেই পারে না!
মহিলাটির কোমরের উপর থেকে উর্ধাংশ অবিকৃত, নিম্নাংশ পিষে দিয়েছে মিনিবাস ।থেতলে যাওয়া মাংস- হাড় -রক্ত- ছেঁড়া কাপড় , সব মিলিয়ে এক বীভৎস নারকীয় দৃশ্য। সোমনাথ বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলেন না। শুধু শেষবারের মতো মুখের দিকে একবার তাকালেন। সেই মুখ, সেই নাক, সেই চিবুক- হুবহু মিল ।এমনকি চিবুকের নিচে ডান দিক ঘেঁসে বড় কালো তিল টি ও একই রকম। সোমনাথ ওই তিলে কতদিন আঙ্গুল ছুঁইয়েছেন, ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়েছেন ,স্পর্শ করেছেন জিভ দিয়ে। কিন্তু ,কিন্তু সেতো শকুন্তলার তিল। একি শকুন্তলা? কিন্তু কিভাবে? না, আর ভাবতে পারছেন না সোমনাথ।
ফিরে এসে ড্রাইভারকে বললেন, এক্ষুনি রাস্তা ক্লিয়ার হবে না। আপনি গাড়ী ঘুরিয়ে নিয়ে চলুন।
গাড়ি ঘুরে চলল । আর গাড়িতে বসেই সেই মুহূর্তে সোমনাথ সিদ্ধান্ত নিলেন যে, ,আগামীকালকেই তিনি গ্রামের বাড়িতে যাবেন। তাকে জানতেই হবে শকুন্তলা এখন কোথায় আছে ,কেমন আছে। হঠাৎই যেন অনেকদিন পরে শকুন্তলার জন্য তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
শ্বশুরবাড়িতে ফিরেও তিনি স্বাভাবিক হতে পারছিলেন না। থেকে থেকেই তার মনে পড়ে যাচ্ছিল শকুন্তলাকে জড়িয়ে তার ছোটবেলার অনেক স্মৃতি।
খেতে বসে স্বামীকে অন্যমনস্ক দেখে সুতপা বললেন, কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ লাগছে নাকি ?
সোমনাথ নিরুত্তর ।অবাক হলেন সুতপা। স্বামীকে এরকম অন্যমনস্ক কখনো দেখেননি। দেবশ্রী ও বাবার এইরকম অবস্থা দেখে অবাক হয় ।সে একটু জোরে চিৎকার করে উঠে, বাবা? সোমনাথ চমকে উঠে বলেন, কিছু বললি তিতলি?
সোমনাথ এই নামেই ডাকেন মেয়েকে। মেয়েকে নিরুত্তর দেখে সোমনাথ বলে ওঠেন, কিরে চুপ করে কেন তিতলি ?কি বলছিলি বল?
দেবশ্রী জবাব দেয়, আমি না বাবা, মা কিছু বলছিল তোমাকে।
সোমনাথ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন, ও হ্যাঁ ,কি বলছিলে বলো? আমি বোধহয় ঠিক খেয়াল করিনি।sorry!
--- তোমার কি শরীর খারাপ করছে ?
---কই নাতো, কিছু হয়নি তো আমার ।
---কি যেন ভাবছ মনে হচ্ছে।
--- ভাবছি কালকে আমি গ্রামের বাড়িতে যাব। ------হোয়াট !কালকে ?কিন্তু টিকিট তো আমাদের কাটা আছে দুদিন পরে।
--- আমি তো তোমাদের যাওয়ার কথা বলিনি ।-------মানে ?
-----ট্রেনের রিজার্ভেশন যেদিনের আছে, সেদিন তোমরা যাবে। আমাকে কাল গ্রামে যেতেই হবে।
---কেন? কেন কালকে তোমাকে যেতেই হবে ?কি হয়েছে?
---দরকার আছে।
----হঠাৎ কি এমন দরকার পড়ল তোমার যে কালকেই ছুটতে হবে?
সোমনাথ নিরুত্তর।
কোন মন্তব্য নেই