আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে (প্রথম অংশ)

 


"আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে (প্রথম অংশ) "

✒ সমীরণ সরকার


(এক)


ট্রেনটা হাওড়া থেকে ছাড়তেই অনেকটা দেরি করে দিল। পথেও লেট। যে স্টেশনে দাঁড়াচ্ছে আর ছাড়ার নাম করছে না। এভাবে চললে তো গিধনি পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। কামরার ভিতর যাত্রী খুব বেশি না থাকলেও প্রত্যেকেই অস্থির এবং বিরক্ত হয়ে উঠেছে। আরো মুশকিল হয়েছে কামরার সব জানালা গুলো খোলা না থাকায়। মাঝেমাঝেই বৃষ্টি নামছে আর জানলাগুলো পড়ে যাচ্ছে ঝপ ঝপ করে। বৃষ্টি থামলে যদিও বা কেউ কেউ জানলা খুলে দিচ্ছে, অনেকেই আবার বৃষ্টি আসতে পারে এই আশঙ্কায় জানলা আর তুলছেই না । তার মধ্যে আবার দু একজন যাত্রী এদিক ওদিক তাকিয়ে চোরাগোপ্তা সিগারেট ধরিয়েছে ।এই পোড়া তামাকের গন্ধটা একেবারেই সহ্য করতে পারেন না সোমনাথ, সোমনাথ মুখার্জি। তাই বৃষ্টির ছাঁট উপেক্ষা করেও জানলা খোলা রেখে বসে আছেন তিনি ।
বাইরে ঝোড়ো বাতাস বইছে একটানা। সকাল ন'টা নাগাদ যখন শ্বশুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলেন তখনই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছিল।
স্ত্রী সুতপা বারংবার নিষেধ করেছিলেন আসতে।
সুতপা বলেছিলেন ,দুদিন বাদ দিয়েই তো আমরা যাব বিয়ের দিনে। আমাদের সঙ্গে একসঙ্গে গেলেই তো পারো। আজকে হঠাৎ তোমার এমন কি প্রয়োজন পড়ল যে ,এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরোতে হবে? তাছাড়া ট্রেনের রিজার্ভেশন তো পাওনি আজ । আর পাবেই বা কি করে? এরকম হঠাৎ করে ডিসিশন চেঞ্জ করলে কি ট্রেনের রিজার্ভেশন পাওয়া যায় ? আমাদের সবারই তো একসঙ্গে পরশুর তারিখে ট্রেনে সিট রিজার্ভেশন করা আছে ।
সোমনাথ ঠান্ডা গলায় জবাব দিয়েছিলেন, এসব কথা আমাকে কেন বলছ? সবই তো আমি জানি সুতপা ।
------ জানো যদি তাহলে যাচ্ছ কেন হঠাৎ করে? কি হল তোমার যে আজকেই তোমাকে যেতে হবে ?
সোমনাথের শাশুড়ি বিবাদ মেটানোর জন্য উদ্যোগী হয়ে মেয়েকে বললেন ,তুই বারবার জামাইকে একই কথা কেন বলছিস তপু?
ও তো বারবার বলছে যে, প্রয়োজন আছে বলে ও আজকে যাচ্ছে।
----- সেটাইতো আমি জানতে চাচ্ছি মা, হঠাৎ করে ওর কি এমন প্রয়োজন হল যে আজকেই যেতে হবে ওকে গ্রামের বাড়িতে? তুমি ভাবতে পারছ মা এতটা রাস্তা ওকে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে যেতে হবে!
----- আমার কোন অসুবিধা হবেনা সুতপা।
------ তবুও যাবে তুমি!
------ বললাম তো দরকার আছে আমার।
------- লাস্ট কবে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে চেপেছ মনে পড়ে তোমার?
------ অত মনে নেই আমার।
------ মনে থাকার কথা নয় ।কারণ গত দশ বছরে আইদার প্লেন অর সুপারফাস্ট ট্রেন ছাড়া ট্রাভেল করনি তুমি।
সোমনাথ কিছু বলার আগেই এবার আসরে নামে মেয়ে দেবশ্রী। বাবাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি এরকম জেদ কেন করছ ড্যাড?
মাম্মি তো ঠিকই বলছে। প্যাসেঞ্জার ট্রেনে যাওয়া কি তোমার পক্ষে সম্ভব ? লোকাল ট্রেনে তো লেবার শ্রেণীর লোক আর কিছু গেঁয়ো চাষারা চাপে বলে শুনেছি!
ক্লাস ইলেভেনে পড়া মেয়ের মুখে এই কথা শুনে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে সোমনাথের ।এতক্ষণ সুতপার সঙ্গে বিরক্তিকর কথা কাটাকাটিতে মেজাজটা তার খারাপ হয়েই ছিল।হঠাৎ দেবশ্রীর কথায় যেন আগুনে ঘি পড়ল। দপ করে জ্বলে উঠলেন সোমনাথ ।
মেজাজ হারিয়ে মেয়েকে বলে উঠলেন, ডোন্ট টক ননসেন্স!
--- সরি ড্যাড।
---- ইউ শুড বি!
সুতপা আর বাধা দেননি স্বামীকে।
দিল্লি থেকে যখন ওরা বের হন তখন অবশ্য প্রোগ্রাম টা একটু অন্যরকম ছিল ।কলকাতায় এসে নিউ আলিপুরে শ্বশুরবাড়িতে দুদিন থেকে, শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কের কয়েকজন আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দেখা করে, তারপর সবাই মিলে একসঙ্গে গ্রামের বাড়িতে রওনা হওয়ার প্ল্যান ছিল ।সেইমতো রিজার্ভেশন করা ছিল ট্রেনে। গতকাল সকালে তারা দিল্লি থেকে প্লেনে কলকাতা পৌঁছেছেন। আজকে কথা ছিল বেহালায় মাসি শাশুড়ির বাড়ি বেড়াতে যাবার।
কিন্তু গতকাল বিকেলে ঘটে যাওয়া সেই মারাত্মক দুর্ঘটনার পরেই সোমনাথের মনে তীব্র ইচ্ছে জেগে ওঠে, গ্রামের বাড়িতে যাবার ।
আর তাই মনস্থির করে ফেলেন যে, পরদিনই তিনি গ্রামের বাড়িতে যাবেন।
ছাত্রজীবন থেকেই কলেজস্ট্রিট সোমনাথের প্রিয় জায়গা ।অবসর পেলেই ঘুরে বেড়াতেন বইয়ের দোকানে দোকানে। ঘেঁটে দেখতেন নতুন নতুন বই ।পছন্দ করে সব বই কিনে নিতে পারতেন এমন সংগতি তখন তার ছিল না। কিন্তু বইটা নিজ হাতে নেড়েচেড়ে একটা অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করতেন তিনি। তারপর চেষ্টা করতেন কোন লাইব্রেরী থেকে বইযোগাড় করা যায় কিনা।
টুকটাক লেখার অভ্যাস ছিল তার তখন। তাই ঘুরে বেড়াতেন পত্র পত্রিকার অফিসে ।এখানে সেখানে জমা দিতেন নিজের লেখা কবিতা ।প্রকাশিত হত দু'চারটে ।আনন্দে মন ভরে উঠতো তার ।বন্ধু-বান্ধবদের দেখাতেন ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত তাঁর লেখা কবিতা ।তাদের মধ্যে দু- চারজন কবিতা পড়ে ভাল মন্তব্য করলে খুব খুশি হতেন‌। পকেটে পয়সার টান থাকলেও সেই বন্ধুদের নিয়ে কফি হাউসে চলে যেতেন কফি খেতে।
গতকাল কলকাতায় পা দিয়েই ওই সমস্ত কথা তার বেশি করে মনে পড়তে লাগলো ।তাই স্নান খাওয়া সেরে শ্বশুরবাড়ি থেকে তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন কলেজ স্ট্রিটের উদ্দেশ্যে ।আর সেখানে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ সম্মুখীন হলেন সেই দুর্ঘটনার । বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল তার । সম্ভব হলে তখনই হয়তো পৌঁছে যেতেন নিজের গ্রামে। আর তখনই স্থির করলেন যে, পরের দিনই গ্রামের বাড়িতে যাবেন। তা না হলে........!



(ক্রমস...)

কোন মন্তব্য নেই

luoman থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.